টানা চার মাসের মধ্যে মাঝের দু’মাসে তেমন গন্ডগোল নেই। কিন্তু প্রথম আর শেষের দু’মাসের হিসেবটা ওলটপালট হয়ে যাওয়ায় গোল বেঁধেছে।
জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চার মাস এ রাজ্যে কাগজে-কলমে বর্ষাকাল। কিন্তু ‘বর্ষায়’ মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধাঁচ ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে। সেই পরিবর্তনের প্রবণতা থেকে স্পষ্ট, জুলাই-অগস্টে বৃষ্টিপাতের ধরন তেমন না-বদলালেও জুনের বৃষ্টি ভীষণ ভাবে কমেছে, উল্টো দিকে বৃষ্টি অনেকটা বেড়েছে সেপ্টেম্বরে। অর্থাৎ বর্ষার আগমনেই বিলম্ব ঘটছে। জুনের ঘাটতি সেপ্টেম্বরে কিছুটা পুষিয়ে গেলেও ইদানীং মোট বর্ষণে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
এবং বর্ষার এ হেন মতিবদলের কোপ পড়েছে কৃষির সঙ্গে পরিবেশের উপরেও। এক দিকে যেমন ধান ও পাটচাষিরা সমস্যায় পড়ছেন, ফলন মার খাচ্ছে, অন্য দিকে তেমন বাড়ছে আর্সেনিক-দূষণের প্রবণতা।
কৃষিক্ষেত্রে বর্ষা-সমস্যার প্রতিফলন রয়েছে রাজ্য সরকারের রিপোর্টেও। ‘অ্যাকশন প্ল্যান অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক রিপোর্টটি জানাচ্ছে, ২০০৮-০৯ অর্থবর্ষের তুলনায় ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে আউস ধানের উৎপাদন কমেছে ১ লক্ষ টনের বেশি। আমনের ফলন হ্রাস পেয়েছে অন্তত ৫৭ লক্ষ টন। কৃষি-আবহবিদ দিলীপ দাসের কথায়, “গত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি, ২০০৫ পর্যন্ত রাজ্যে বৃষ্টিপাতের ধরনে ৮%-৯% পরিবর্তন হয়েছে।” যে ‘পরিবর্তনের’ মধ্যেই আবার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার বড় ইঙ্গিত দেখছেন নদী ও ভূ-জল বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। কী রকম?
কল্যাণবাবুর ব্যাখ্যা, “প্রখর গ্রীষ্মের পরে জুনে প্রথম বৃষ্টির জল পড়া মাত্র শুকিয়ে থাকা মাটি তা ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নেয়। সেই জল যেমন মাটিকে রস জোগায়, তেমন ভূগর্ভের জলস্তরকে সমৃদ্ধ করে। তা ছাড়া বর্ষার চার মাস সমান বৃষ্টি হলে চাষের পক্ষেও সুবিধা। কিন্তু অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টি হলে অসুবিধেই বেশি। বেশিটাই গড়িয়ে নদীতে চলে যায়, কিংবা প্লাবন হয়। অতিবৃষ্টির জল মাটির নীচে প্রবেশ করে সামান্যই।” কল্যাণবাবুর বক্তব্য: গত ১০২ বছরের বৃষ্টি-তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, জুনে ১৫% কম বৃষ্টি হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে ১০% বেশি। উপরন্তু মোট বৃষ্টিপাতে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ জলের উপরে কৃষির নির্ভরতা অনেক বেড়ে যাচ্ছে, মাটির নীচের জলভাণ্ডারে কোপ পড়ছে। অথচ বৃষ্টির খামখেয়ালিপনায় ভূগর্ভে জলের খামতি মিটছে না। অসময়ের অতিবৃষ্টি কাজে আসছে না। পরিণামে ভূগর্ভে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বাড়ছে।
কৃষি-পণ্যের উৎপাদনে সামঞ্জস্যহীন বর্ষার প্রভাবের অন্যতম দৃষ্টান্ত পশ্চিমবঙ্গের দুই অন্যতম অর্থকরী ফসল ধান ও পাট। বিলম্বিত বর্ষা পাটগাছের বৃদ্ধি রুখে দিচ্ছে, পাট পচানোর জলও মিলছে না। বৃষ্টিতে টইটম্বুর খাল-বিল-নয়ানজুলির জলে পাট পচানো হয়। কিন্তু পর পর কয়েক বছর জলের অভাবে বহু চাষিকে পাট কেটে জমিতেই ফেলে রাখতে হয়েছিল। অল্প জলে পাট পচানোর কারিগরি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও তার ফল চাষিদের কাছে এখনও পৌঁছয়নি।
গত ক’বছরে জুনের বৃষ্টিতে টান পড়ায় ধানচাষিরাও বিলক্ষণ ভুগছেন। খরিফ মরসুমে ধানের বীজতলা তৈরি করতে দেরি হচ্ছে, ফলে ধান রুইতেও দেরি হচ্ছে। কৃষিবিদেরা জানাচ্ছেন, বিলম্বিত রোপনের দরুণ ধান ফলানোর মোট সময়টা কমে যায়। ধানের শিস তো ছোট হয়ই, সেই শিসের সব ধান পুষ্টও হয় না। ধান চিটে হয়ে যায়।
তা হলে উপায়?
চুঁচুড়া ধান গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানী বিজন অধিকারী বললেন, “বৃষ্টির পিছিয়ে যাওয়ার প্রবণতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে ধান চাষের পদ্ধতি বদলানোর বিষয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। ধানের গোড়া সব সময় জলে ডুবিয়ে না-রেখে জমি পর্যায়ক্রমে ভিজিয়ে-শুকিয়েও ভাল ফলন সম্ভব। তাতে রোগ-পোকার উপদ্রবও কমে।” সহবাগী, সিদ্ধান্ত, জলদি-১৩ বা অঞ্জলির মতো কয়েকটি জলদি জাতের শীঘ্র ফলনশীল ধান চাষ করলেও কিছুটা সুরাহা হতে পারে বলে কৃষি-বিজ্ঞানীদের দাবি। তাঁদের বক্তব্য, ওই সব ধান ৯৫ দিনে পেকে যায়। ২১ থেকে ২৫ দিনের চারা রোপন করে কম জলে চাষ করলে তেমন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গবেষণাকেন্দ্রে আরও বেশি খরা সহনশীল জাতের ধানবীজ তৈরিরও চেষ্টা চলছে। |