ব্যাগ গুছিয়ে...
মেঘ বাগিচার রূপকথা
মেঘ সরে গেলে বেরিয়ে পড়ে পুরনো বাংলো আর তাকে ঘিরে বিশাল লন। এ দিক ও দিকে ছড়ানো ভিউ পয়েন্ট। আচমকাই কেমন বয়স কমে যায় তখন! আর চার দিকে যদি পাহাড় ঘেঁষে আসে? যে কোনও একটা ভিউ পয়েন্টে বসে পড়তে ইচ্ছে হয় গিটার নিয়ে। হু হু বাতাসের সঙ্গে ঝংকার পড়ুক স্ট্রিংয়ে। সমবেত কণ্ঠে উঠুক গান, যেমন হতো কলেজ জীবনে। ও গানওয়ালা, আমার আর কোথাও যাবার নেই। কিচ্ছু করার নেই!
এটাই সেলিম হিলের থিম সং। এখানে এলে আর কোথাও যাওয়ার থাকে না।
অথচ, একটু আগে, মেঘের ভিতর দিয়ে গাড়িটা যখন খাড়াই নামছিল, এ সব কথা ভুলেও মাথায় আসেনি। গাড়িতে সব মিলিয়ে পাঁচ জন বাচ্চা। তারা হাতল চেপে বসে আছে। নীচে যেটুকু চোখ পড়ে, তাকালেই মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। উল্টো দিক থেকে গাড়ি এলে পিছু হটে পাহাড়ের গায়ে সেঁটে জায়গা দিতে হচ্ছে। আবার গড়িয়ে যাচ্ছি কুয়াশা ভেদ করে।
ড্রাইভারকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করছি, এ ভাবে প্রাণ হাতে আর কত দূর? মজার কথা হল, সরোজ তামাং, আমাদের যাবতীয় দায়িত্ব তখন যার হাতে, থুড়ি স্টিয়ারিংয়ে, সে নিজেও জানে না জায়গাটা কোথায়! রাস্তায় জনমানুষ নেই যাকে জিজ্ঞাসা করে জানব।
তখনও কিন্তু জানি না, রাস্তা যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে অপেক্ষা করে আছে ব্রিটিশ আমলে পাথরে তৈরি প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো একটা বাংলো। যেখানে চারটে ডবল বেডরুম। জানি না, বিরাট কম্পাউন্ডে যে ভিউ পয়েন্টগুলো আছে, তার কোনওটা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় (সে ভাগ্য আমাদের হয়নি। জুনের গোড়ায় চারদিকে শুধু মেঘ আর মেঘ)। কোনওটা থেকে দেখা যায় পায়ের তলায় বিছিয়ে থাকা গোটা সমতল। শিলিগুড়ি শহর।
দুপুরে গিয়ে যখন ঢুকলাম সেলিম হিলের কম্পাউন্ডে, তখন সেটা মেঘের সাম্রাজ্য। তবে পাহাড়ে তো মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলাতেই মজা। বিকেলে বৈঠকখানায় আসতেই দেখি, কোথায় মেঘ? পাশে, প্রায় ঘরের গা ঘেঁষে জেগে উঠেছে একটা পাহাড়। এটা এখানে ছিল? কই, বুঝতে তো পারিনি! ততক্ষণে হাজির সেলিম চা বাগানের ম্যানেজার মিস্টার রাঠৌর। তাঁর সঙ্গে চা বাগিচার ইতিহাস। আর ইতিহাসের গল্প বলা সব ছবি।
রাঠৌরের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, হেনরি নামে এক সাহেব এই বাগানটা তৈরি করেন। তার পর তাঁর পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনেকেই এখানকার বিভিন্ন চা বাগানে ম্যানেজার হয়েছেন। স্বাধীনতার পরে ৬০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। হেনরিদের সে দিন আর নেই। পরিবারের সকলেই চলে গিয়েছেন ভারত ছেড়ে। তাঁদেরই এক জন, বয়স প্রায় আশি, গত বছর ইন্টারনেটে খোঁজ পেয়ে এসেছিলেন বাগান দেখতে। নিজের শৈশবের স্মৃতি খুঁজতে। রাঠৌর বলছিলেন, সব দেখেশুনে উনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন। বলে গেলেন, যত দিন বেঁচে আছি, বছরে এক বার অন্তত আসব। কিন্তু সেলিম হিল কেন? কেউ কেউ বলেন, হেনরির পরে যিনি এই বাগানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, স্থানীয় মানুষ তাঁকে আদর করে ডাকত, সেলিম সাহেব। আবার কারও কারও মতে, চার দিকে পাহাড়গুলো যেন ভেসে বেড়াচ্ছে এই বাগিচাকে ঘিরে। সেই ভেসে বেড়ানো বা ‘সেইলিং হিলস’ বিশেষণই পরে অপভ্রংশ হয়ে সেলিম হিল নামে এসে দাঁড়িয়েছে। এই গল্পের ফাঁকে রাঠৌর জানালেন, এখানে এসে বেশ কিছু দিন কাটিয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথও। তাঁর একটি বড় ছবি রয়েছে বাংলোর বৈঠকখানায়।
তখনও জানি না, রাতের অন্ধকারে নক্ষত্রবীথিকার মতো জেগে উঠবে সাড়ে তিন হাজার ফুট নীচের সমতল। নাকি বলব ভেলভেটে ছড়িয়ে থাকা নানা রঙের মণিমুক্তো? অথবা হিরের নেকলেস?
তখনও জানি না, পাশের পাহাড়ে চা বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে এক একটা বাঁকে পরতে পরতে খুলে যাবে নতুন ছবি। এমন ঢেউয়ের মতো পাহাড়, তাদের শরীর জুড়ে ছেয়ে থাকা এমন সবুজ চা বাগিচা! ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে কর্মীদের। তাঁরা কেউ কাজ করছেন, কেউ হেঁটে যাচ্ছেন কারখানার দিকে, কেউ কাজ সেরে নামছেন নিজের গ্রামে। বলতেই দাঁড়িয়ে পড়লেন ক্যামেরার সামনে। তার পরে বলে গেলেন, ছবিগুলো পাঠিয়ে দেবেন ই মেল-এ!
দেড়শো বছরের পুরনো বাংলোটা পাথরে তৈরি। লম্বা বারান্দায় আরাম কেদারাটা যেন সব নাগরিক শ্রান্তি শুষে নিয়ে আপনাকে চাঙ্গা করে দেওয়ার জন্যই বসে আছে। এই উচ্চতায় লাল-নীল-কমলা-বেগুনি রঙা ফুলের সমারোহ সব থেকে বেশি দেখা যায়। আবহাওয়া না-ঠান্ডা না-গরম। তবে ডিসেম্বরে আগুন জ্বালিয়ে হাত-পা সেঁকে নিতেই হবে।
বাংলোর সব থেকে আকর্ষণীয় জায়গাটি হল এর দোতলার বৈঠকখানা। মূল বাংলো থেকে এগিয়ে সাত-আটটা কাঠের ডান্ডার উপরে দাঁড় করানো লম্বা কাঠের ঘরটি আড্ডার জন্য দারুণ জায়গা। সেখানে শো কেসের পাশে যে গড়গড়াটা রয়েছে, তাতে ধূমপান উপভোগ করতে পারেন। আর অবশ্যই পারেন অসাধারণ রান্নার স্বাদ নিতে। রাতে ক্যাম্প ফায়ার করতে চাইলে সে ব্যবস্থাও হতে পারে।
নিস্তব্ধ রাতে, যখন পাহাড় চলে গিয়েছে অন্ধকারের আড়ালে, চার দিকে ছড়িয়ে থাকা পোকারাও ঘুমোনোর তোড়জোড় করছে, বসুন সামনের ভিউ পয়েন্টে। নীচে বয়ে যাচ্ছে আলোর জীবন। যত ক্ষণ ইচ্ছে তাকিয়ে থাকুন। সারা রাত বসে থাকলেও আশ মিটবে না।

কী ভাবে যাবেন
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন বা শিলিগুড়ি থেকে হিলকার্ট রোড ধরে গাড়িতে ৩৫-৪০ কিলোমিটার।
বাস বা অন্য কোনও নিয়মিত গাড়ি যায় না। তাই গাড়ি পুরো ভাড়া করতে হবে।
কখন যাবেন
বছরের যে কোনও সময়। তবে বর্ষায় পোকামাকড়ের সমস্যা আছে।
কোথায় থাকবেন

সেলিম হিল টি এস্টেটে থাকার জায়গা একটিই। সেখানে থাকা-খাওয়া সমেত বুকিং করা যায়।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.