সিরিয়ায় ১৬ মাস ব্যাপী রক্তপাত, সংঘর্ষ ও হানাহানির অবসানের কোনও লক্ষণ নাই। ইহা বন্ধ করিতে কিংবা সিরিয়া সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে রাষ্ট্রপুঞ্জ তথা আন্তর্জাতিক বিশ্বেরও বিশেষ মাথাব্যথা লক্ষিত হইতেছে না। প্রশ্নটি সিরিয়া আক্রমণের নয়, স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদকে গদিচ্যুত করারও নয়। কিন্তু হাজার-হাজার নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ নিত্য সেখানে হতাহত হইবেন, ইহাও কাম্য হইতে পারে না। অথচ সিরিয়ায় ঠিক তাহাই ঘটিয়া চলিয়াছে। কেননা আসাদ-বিরোধীদের বিদ্রোহ এখন কার্যত গৃহযুদ্ধে পরিণত। আর সেই যুদ্ধ সিরিয়ার ভৌগোলিক সীমান্তে আবদ্ধ না থাকিয়া রাজধানী দামাস্কাসে পৌঁছাইয়া গিয়াছে। প্রতিরক্ষার সদর দফতরে বিস্ফোরণে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নিহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, অবস্থা কতখানি ভয়াবহ।
অথচ প্রেসিডেন্ট আসাদ এখনও কোনও আপসে সম্মত নহেন। আরব লিগের মধ্যস্থতা প্রয়াস, রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের শুভেচ্ছা-প্রয়াসও ব্যর্থ। গৃহযুদ্ধ ক্রমে শিয়া শাসক গোষ্ঠী বনাম সুন্নিপ্রধান বিরোধী পক্ষের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সংঘাতেরও চেহারা লইতেছে। উপর্যুপরি প্রত্যাঘাতে কোণঠাসা আসাদ সরকার মরণ-কামড় দিতে শেষ পর্যন্ত রাসায়নিক মারণাস্ত্রের সম্ভার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করিতে পারে, এমন শঙ্কাও উড়াইয়া দেওয়া যায় না। লেবানন ছাড়াও প্রতিবেশী ইরাক এবং তুরস্কে উপচাইয়া পড়িতেছে গৃহযুদ্ধের পরোক্ষ অপচয়, যাহা গোটা পশ্চিম এশিয়াকেই অগ্নিগর্ভ করিয়া তুলিতে পারে, বিশেষত আয়াতোল্লা শাসিত ইরান যেখানে দৃঢ় ভাবে আসাদের সমর্থনে দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জ অসহায়। কারণ আর কিছুই নয়, নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চিনের ভেটো। সিরিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া আসাদ সরকারকে নমনীয় ও আপসকামী হইতে বাধ্য করার যে সুযোগ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে ছিল, রাশিয়া ও চিনের ভেটো প্রয়োগের ফলে তাহা নূতন করিয়া হাতছাড়া।
দুই দেশই নিষেধাজ্ঞা-প্রস্তাবের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রণনৈতিক স্বার্থ খুঁজিতেছে। অথচ সিরিয়া ও ইরানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গোষ্ঠীকে হাতে রাখিয়া পশ্চিম এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব-বলয় প্রসারিত করার রণনৈতিক স্বার্থের কথাটি মস্কো এবং বেজিং উভয়েই চাপিয়া যাইতেছে। এই স্বার্থসিদ্ধির প্রতিযোগিতাই কিন্তু সিরিয়ার অব্যাহত রক্তক্ষয় ও গৃহযুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ার হেতু। স্বভাবতই চিন-রাশিয়ার বাধার সম্মুখে পড়িয়া পশ্চিমী গণতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে সিরিয়ার সঙ্কট সমাধানের অন্যতর চিন্তাও মাথা-চাড়া দিতেছে। নিরাপত্তা পরিষদকে এড়াইয়া কিছু করা যায় কি না, সেই সম্ভাবনাও খতাইয়া দেখা শুরু হইয়াছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বতন্ত্র ভাবে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত লইয়াছে, যেমন সিরিয়াকে অস্ত্র ও সমরসম্ভার বিক্রি বন্ধ করা, সিরিয়াগামী অস্ত্রবাহী জাহাজ ও বিমানে তল্লাশি চালানো এবং বিদেশে আসাদ-ঘনিষ্ঠ সিরীয়দের গচ্ছিত সম্পদ আটক করা। অন্তত নেটো-র তরফে সামরিক হস্তক্ষেপের তুলনায় এই চাপ সৃষ্টি অনেক বেশি বাঞ্ছিত। সিরিয়ার সংকট আরব বসন্তের মধ্য দিয়া উৎসারিত জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ না-হওয়ার সঙ্কট। তবু একা আরবরা ইহার মীমাংসা করিতে অক্ষম। |