শেষ দৃশ্যের অভিনয় ঠিক কী ভাবে হবে, ‘আনন্দ’-এর শ্যুটিংয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না তাঁর। মুম্বইয়ে অভিনেতা মেহমুদের বাড়িতে তখন থাকছিলেন অমিতাভ বচ্চন। মেহমুদ তাঁকে বলেন, চিন্তার কিছু নেই! “শুধু এটা ভাববে যে, রা-জে-শ খ-ন্না মারা গিয়েছেন!” হিন্দি সিনেমার বিশ্বকোষে জায়গা করে নিয়েছে ‘আনন্দে’র সেই শেষ দৃশ্য।
রাজেশ-অমিতাভ সম্পর্কের উপর দিয়ে পরের চল্লিশ বছরে আরব সাগরের অনেক ঢেউ ভেঙেছে। ১৯৭৩-এ ‘জঞ্জীর’ দেখে অমিতাভকে ভবিষ্যৎ তারকা বলে চিহ্নিত করেছিলেন রাজেশ নিজেই। কিন্তু ঘটনাটা যখন সত্যিই ঘটল, নিজের মুকুট সরে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেননি তিনি। দু’জনের মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল শীতল দূরত্ব।
তবে রাজেশ যখন সত্যিই জীবনকে ‘অলবিদা’ বললেন, কান্নার বেগ সামলাতে পারলেন না অমিতাভ। গত কালও কেঁদে ফেলেছিলেন। আজও অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে ঝরঝর করে কাঁদতে দেখা গেল তাঁকে। |
যে প্রতিভা বাছাই প্রতিযোগিতা থেকে পর্দায় রাজেশের আবির্ভাব, সেই একই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন অমিতাভও। আজ নিজের ব্লগেই তিনি লিখেছেন, বাছাই তালিকাতেই আসতে পারেননি। ১৯৭১ সালে যখন ‘আনন্দ’ তৈরি হচ্ছে, অমিতাভ তখনও নেহাতই ‘স্ট্রাগল’ করে চলা এক নবাগত। ‘সুপারস্টারে’র সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়েই মশগুল তিনি। তার আগেই মায়ের সঙ্গে দেখেছেন ‘আরাধনা’। রাজেশের সঙ্গে অভিনয় করতে পারাটাই তখন তাঁর কাছে একটা বড় সাফল্য। ব্লগে অমিতাভ কবুল করেছেন, “রাজেশের সহ-অভিনেতা বলেই তখন আমার গুরুত্ব খানিকটা বাড়ছিল।”
মনে রাখা যাক, ওই ১৯৭১-এই রাজেশের রেকর্ড ব্যবসা দেওয়া ছবি ছিল, ‘হাতি মেরে সাথী’। এবং সেই ছবিতে রাজেশেরই উদ্যোগে প্রথম বার চিত্রনাট্য লেখার জন্য জোট বাঁধেন, সেলিম-জাভেদ। তার ঠিক চার বছর পরের চিত্রটা কী? ১৯৭৫ সাল। সেলিম-জাভেদই সরাসরি যশ চোপড়াকে বলে দিচ্ছেন, চিত্রনাট্যের প্রতি সুবিচার যদি করতে হয়, কোনও মতেই রাজেশকে নেওয়া চলবে না। রাজেশের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে অমিতাভকে নিচ্ছেন যশ ছবির নাম, অবশ্যই ‘দিওয়ার’।
চার বছরের মধ্যে রাজেশ আর অমিতাভের অবস্থান পাল্টে গিয়েছিল ১৮০ ডিগ্রি। ‘আনন্দ’-এর পর হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়েরই ‘নমক হারাম’-এ (১৯৭৩) দু’জনে আরও এক বার একসঙ্গে ছিলেন। তার পর অমিতাভ-ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ-শশী, অমিতাভ-বিনোদ খন্না...অনেক বার দেখা গিয়েছে। অমিতাভ-রাজেশ জুটি ফিরে আসেনি। ঘনিষ্ঠরা বলেন, রাজেশ-ডিম্পলের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পিছনে রাজেশের কেরিয়ারের টালমাটাল অনেকটা দায়ী। আর, কেরিয়ারের টালমাটালের জন্য দায়ী ওই লম্বা মানুষটির ছায়া। আজ যখন চিরশয্যায় শায়িত রাজেশের দেহের সামনে দাঁড়িয়ে পরস্পরের চোখের জল ভাগ করে নিচ্ছিলেন অমিতাভ আর ডিম্পল, ইতিহাসের অনেকগুলো পাতা দ্রুত উড়ে আসছিল। |
১৯৭৩ সালে রাজেশের কাছ থেকে যখন আচমকা বিবাহ-প্রস্তাব এসেছিল, ১৬ বছরের ডিম্পল তাকে স্বপ্ন বলেই মনে করেছিলেন। দু’বার ভাবার জায়গা ছিল না। তামাম মহিলাকুলের হৃদয় ভেঙে নিজের প্রথম ছবি ‘ববি’ মুক্তি পাওয়ার আগেই রাজেশের ঘরণী হয়ে যান ডিম্পল। আক্ষরিক অর্থেই ঘরণী, কারণ রাজেশ কোনও দিনই চাননি, ডিম্পল আর অভিনয় করুন। ডিম্পল পরে বলেছিলেন, ‘জীবন থেকে সুখ শব্দটা হারিয়ে গিয়েছিল বিয়ের পরপরই’। রাজেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বারবার খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ডিম্পল অজস্র বার বাড়ি থেকে চলে গিয়েছেন, রাজেশের জীবনে অন্য নারী এসেছেন, ডিম্পলও পর্দায় ফিরেছেন। কিন্তু ডিম্পল-রাজেশ পূর্ণচ্ছেদ কিছুতেই হয়নি।
১৯৯২ সালে রাজেশ যখন সাংসদ পদের জন্য লড়ছেন, নির্বাচনী প্রচারে যথারীতি হাজির ডিম্পল। ওই সময়েই রাজেশ ‘জয় শিব শঙ্কর’ বলে একটি ছবি প্রযোজনা করেন, তাতে ডিম্পলও ছিলেন। তবে ঘনিষ্ঠেরা বলেন, রাজেশের জীবনে সত্যিকারের অন্তরাল এবং একাকিত্বের পর্ব শুরু হয় ১৯৯৬-এর পর থেকে। রাজনীতি, সিনেমা কোথাওই আর নেই তখন তিনি। তাঁর জীবনে নেই ডিম্পলও। বিশাল বাংলোয় নিজেকে মদে ডুবিয়ে দিয়ে দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছিলেন যিনি, তিনি অতীত সুপারস্টারের ছায়ামাত্র। |
শেষ লগ্নে একটা পুনর্মিলনের আবহ তৈরি হচ্ছিল গত এক বছর যাবৎ। পারিবারিক সূত্র বলছে, এর পিছনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন জামাই অক্ষয় কুমার। অক্ষয়ই চেষ্টা করছিলেন রাজেশ-ডিম্পলের সম্পর্ক সহজ করতে। গত বছরে সবাই একসঙ্গে গোয়ায় বেড়াতেও গিয়েছিলেন। এবং বরফ গলতে শুরু করেছিল। রোগশয্যার দিনগুলোতে রাজেশের পাশটিতে সব সময় থাকছিলেন ডিম্পল। সহজ হয়েছিল বান্ধবী অঞ্জু মহেন্দ্রুর সঙ্গে সম্পর্ক (আজও উপস্থিত ছিলেন) এবং ফিরে এসেছিলেন রাজেশের অত্যন্ত প্রিয় ভক্তেরা। তাঁদের জন্যই দিন কয়েক আগেও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন রাজেশ। ভক্তদের মাত্রাছাড়া ভিড়ের আশঙ্কাতেই আজ পুলিশ অনুরোধ করেছিল, অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানটি যথাসম্ভব পারিবারিক সীমায় বেঁধে রাখতে। তবু চলেছে লাঠি, ভক্তদের সামালাতে হিমশিম খেয়েছে পুলিশ।
রাজেশ খন্না, বলিউডের প্রথম সুপারস্টারের জন্য এমনই তো হওয়ার কথা। ‘আপ কি কসম’ ছবিতে একটা গান ছিল, জিন্দেগিকে সফর মে গুজর যাতে হ্যায় জো মোকাম, ওহ ফির নেহি আতে...।
জীবনের অন্তিম কিন্তু রাজেশকে তাঁর সুপারস্টার-গরিমা ফিরিয়ে দিল। |