সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরে সাত বছর ধরে নিখোঁজ একমাত্র ছেলের হদিস পেলেন প্রাক্তন বিচারক।
প্রতিদিনের মতো বারুইপুর আদালত থেকে মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ি ফিরছিলেন দক্ষিণ শহরতলির সুভাষগ্রামের বাসিন্দা প্রাক্তন বিচারক সুনীল দাম। তখনই টেলিভিশনের খবরে শুনলেন পুরুলিয়ায় বিক্রম নামে এক মাওবাদী নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। সেই বিক্রমই যে তাঁর ছেলে অর্ণব, তা এক প্রকার নিশ্চিত সুনীলবাবু।
এ দিন বিকেলে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সুনীলবাবু বলেন, “২০০৫-এর মার্চে ছেলের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সেই সময়েই জানতে পারি অর্ণব থেকে ও বিক্রম হয়ে গিয়েছে।”
যে অর্ণবকে তাঁরা চিনতেন সে ছিল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। বারাসত প্যারীচরণ সরকার রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে উচ্চ মাধ্যমিক পড়েন। তার পরে খড়্গপুর আইআইটি’তে। ১৯৯৮ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অর্ণব নিখোঁজ হয়ে যান আইআইটি ক্যাম্পাস থেকেই। তখনই থেকেই পরিবারের কাছেও অচেনা হয়ে যেতে শুরু করেন অর্ণব।
সেই ছেলের বিষয়ে কিছু বলতে প্রথমে ইতস্তত করছিলেন প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই সুনীলবাবু। লোহার সদর দরজা এক পাশে একটু খুলে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে দাঁড়িয়েই ধীরে ধীরে বলতে থাকেন, ২০০৫-এর জানুয়ারিতে ব্যারাকপুর থানা থেকে তাঁকে জানানো হয়, বিক্রম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই ব্যক্তি জানিয়েছে, সুনীলবাবুই তাঁর বাবা। তখনই গিয়ে তিনি দেখতে পান, বিক্রম তাঁরই ছেলে অর্ণব। মাওবাদী নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁকে। ছেলের জামিনের আবেদন করেন সুনীলবাবু। তা মঞ্জুর হওয়ার পরে মাস দু’য়েক বাড়িতেই ছিলেন বিক্রম ওরফে অর্ণব।
ওই দু’মাসেই সুনীলবাবুরা বুঝতে পারেন, এই অর্ণবকে তাঁরা একেবারেই চেনেন না। সুনীলবাবু বলেন, “বাড়িতে তখন খুব বেশি কথা বলত না। খবরের কাগজ পড়ত। আর টিভি দেখত। বিশেষ বেরোতও না। মার্চের প্রথম দিকে এক দিন বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ছেলের আর কোনও খোঁজ পাইনি।” বেশ কিছু ক্ষণ চুপচাপ থাকেন সুনীলবাবু। আবার বলেন, “খুব মেধাবী ছিল। খুব কম সময় পড়ত। কিন্তু সব পরীক্ষায় বরাবর দারুণ ফল করত।”
কিন্তু সেই কৈশোরেই অর্ণবের অন্য একটি পরিচয় বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সহপাঠীরা।
বারাসত স্কুলে তাঁর সহপাঠী সৌম্য চক্রবর্তী জানান, অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন অর্ণব। থাকতেন বারাসতেরই ন’পাড়া হাউসিং-এ। ওই বয়সেই কমিউনিজম নিয়ে নানা বইপত্র পড়ার অভ্যাস ছিল অন্তর্মুখী স্বভাবের ওই কিশোরের। যে কারণে বন্ধু-বান্ধব সহপাঠীদের কাছ থেকে বেশ খানিকটা সমীহও আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি। সৌম্যবাবু বলেন, “আমরা তখন খুবই ছোট। কিন্তু ওই বয়সেও অর্ণবকে দেখতাম ভারি ভারি কমিউনিজমের বই নিয়ে ক্লাসে বসে পড়ছে। বাড়িতেও প্রচুর বইপত্র ছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে এ সব নিয়ে কখনও আলোচনা করত না। রাজনীতির কথা কখনও ওর মুখে শুনিনি। আর পাঁচটা বন্ধুর মতোই সহজে আড্ডা দিত। খেলাধুলাও করত।” সহপাঠীরা জানান, বরাবর ক্লাসে প্রথম সারিতেই থাকতেন অর্ণব। বারাসতে নানা সাহিত্য-পত্রিকার সঙ্গেও মেধাবী ওই ছাত্রের এক সময়ে যোগাযোগ ছিল বলে জানালেন বারাসতের বাসিন্দা শৌভিক পাল। তবে নরেন্দ্রপুরে পড়ার সময় থেকেই বারাসতে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছিলেন অর্ণব।
অর্ণবের মা কল্যাণী সরকার দাম প্রাক্তন স্কুল শিক্ষিকা। স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে এখন বাড়িতেই থাকেন। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে কোনও কথা বলতে চান না। সুনীলবাবু বলেন, “আমরা আর কী বলব, বলতে পারেন? দু’জনই কমবেশি অসুস্থ। অনেক বয়েসও তো হয়েছে।”
ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন? দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আগে প্রাক্তন বিচারক সুনীলবাবু আস্তে আস্তে বলেন, “আইন আইনের পথে হাঁটবে। আমার কিছুই বলার নেই।”
যদি আপনাকে ফের ডাকা হয়? এ বার আর কোনও উত্তর দিলেন না সুনীলবাবু। |