পুস্তক পরিচয় ১...
শিক্ষা কি নিছক আর্থনীতিক বিষয়
কলমচারি/ প্রাথমিক শিক্ষকদের লিখিত অভিজ্ঞতা, সম্পাদনা: কুমার রাণা। প্রতীচী ইনস্টিটিউট।
লোচনার শুরুতেই বলা থাক: যারা পশ্চিমবাংলার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবেন, ভাবতে চান, তাঁদের এই বইটা অবশ্যই পড়ে নিতে হবে।
প্রতীচী আয়োজিত পশ্চিমবঙ্গের আটটি জেলায় দশটি কর্মশালায় ৩৪৮ জন শিক্ষিকা-শিক্ষক লিখে দিয়েছেন তাঁদের কথা। সে সকল লেখা কথা নিয়ে এই বই। যাঁরা এই বইটি বানিয়েছেন, তাঁরা লিখে দিয়েছেন এ মত— ‘শিক্ষকরা নিজেরা শিক্ষার বর্তমান অবস্থা নিয়ে কী ভাবছেন, কোন কোন বিষয়গুলিকে তাঁরা সমস্যা বলে মনে করছেন, গৃহীত কোন পদক্ষেপকে তাঁরা সঠিক বলে মনে করছেন, সমস্যার সমাধান সম্পর্কে তাঁদের চিন্তা কোন পথে চলমান, তাঁরা নিজেরা কী ভাবে কাজ করে চলেছেন ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে সম্যক অনুধাবন।’
শিক্ষিকা-শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা কথা বইনির্মাতাগণ বিভিন্ন অধ্যায়ে ভেঙে দিয়েছেন। বইটি নিয়ে আলোচনাকে বিষয় ধরে এগোই। প্রথম অধ্যায়ের বিষয়: ‘ভর্তি, উপস্থিতি, স্কুলছুট’। সরকারি তথ্যে শিশু-ভর্তিতে সাফল্য। শিক্ষিকা-শিক্ষকদের আলোচনায় শিশুদের স্কুলে অনুপস্থিতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষিকা-শিক্ষকরা এবং আলোচনা সংগঠকরা কারণ খুঁজেছেন। কয়েকটি কারণ আর্থনীতিক, কয়েকটি আপাত সামাজিক। ‘অভিভাবকদের দায়িত্ব পালন না করা’। এই সামনে সামাজিক কারণের পিছনের কারণও আর্থনীতিক। জানানো আছে এই বইতেই: ‘অভিভাবকদের পেশার চরিত্রটাই এমন যে তারা দায়িত্ব পালনের অবস্থায় নেই।’ উদাহরণ দেওয়া হয়েছে: বাবা-মা’দের পড়ুয়া শিশুদের নিয়ে কাজের জন্য বাইরে চলে যাওয়া, ছাত্রীদের পরিচারিকা হয়ে যাওয়া, পড়ুয়াদের অন্য শিশুশ্রম কাজে যোগ দেওয়া। বইতে এমন কথা আছে— ‘আর্থিক অনটনের কারণে শিশুরা বিভিন্ন প্রকার আর্থিক সম্পর্ক যুক্ত কাজে জড়িয়ে পড়ে।’
অনুপস্থিতির আর একটি কারণ জানানো হয়েছে এমন: শিশুদের শারীরিক অসুস্থতা, অপুষ্টি, মিড-ডে-মিল প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও। এরও কারণ আর্থনীতিক। যাদের পয়সা নেই, তাদের পুষ্টি নেই। সব মিলিয়ে অনুপস্থিতির বড় কারণ অর্থনীতি।
শিক্ষিকা-শিক্ষকরা এই অনুপস্থিতির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন স্কুলছুট। তাঁদের মত: অনিয়মিত উপস্থিতিই শেষ পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে স্কুলছুট। এমন সম্পর্ক বানিয়েই তাঁরা থামেননি, আলাদা করে স্কুলছুটের কারণ দেখিয়েছেন, আরও অনেক কিছুর সঙ্গে, শিশুশ্রম, পরিবারের দেশান্তর। সেই আর্থনীতিতেই যাওয়া।
আর্থনীতির বিষয় গড়িয়ে গিয়েছে পরের অধ্যায়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়: ‘ইস্কুল, নানান শিশু’। এই অধ্যায়ে সবচেয়ে বেশি এসেছে যে কথাটি বেশির ভাগ শিশুই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। এই প্রকার একটি অবস্থায় ছেলেমেয়েদের প্রায়শই অর্থ রোজগারের আশায় বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত হতে হয়, পড়া ছাড়তে হয়। এই কথাটিই প্রথম অধ্যায়ে ছিল, দ্বিতীয় অধ্যায়ে এসেছে। শিক্ষা নিয়ে আলোচনায় অর্থনীতি থেকে বেরনো যাচ্ছে না।
শিক্ষিকা-শিক্ষকরা লিখেছেন: বেশির ভাগ ছাত্রীছাত্র প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। আমরা ভাবি: স্বাধীনতা পাওয়ার ৬৫ বছর পরে এখনও ‘বেশির ভাগ’ শিক্ষার্থী প্রথম প্রজন্মের। প্রতিবেদন নির্মাতাদের মন্তব্য: একই সঙ্গে এত দিনের ব্যর্থতা ও এখনকার সফলতার প্রমাণ। মানলাম। আবার দুশ্চিন্তা রাখলামও। এই বইটি পড়েই এমন আশঙ্কায় থাকা— বর্তমান প্রজন্মের এত বেশি সংখ্যক অনুপস্থিত ও স্কুলছুটের ফলে এদের সন্তানরাও কি ‘প্রথম’ প্রজন্মের শিক্ষার্থী হবে স্বাধীনতার ৮০ কি ৯০ বছর পরেও।
আলোচকের আলোচনায় অর্থনীতির ওপর দায় চাপলেও প্রতিবেদন নির্মাতারা সমাজকে, সামাজিক পরিচিতিজনিত কারণে পার্থক্যকে নিয়ে এসেছেন। বলছেন: ‘সব মিলিয়ে দেখতে গেলে সমাজে জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাজনগুলি যে ভাবে পরস্পর জড়িয়ে আছে, সেখানে সমস্যাগুলি সহজ সরল হতে পারে না।’ তথাপি আবার অর্থনীতিতেই, ‘দৈনিক বেঁচে থাকা’র অর্থনীতিতেই এলেন। বললেন, ‘যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই দৈনিক বেঁচে থাকাটাকে সভ্য সমাজ যদি গুরুত্ব ও মর্যাদা না দেয়, তা হলে সমাজের অগ্রগতি কতখানি সম্ভব?’
পরের একটি অধ্যায় ‘স্কুলের খাবার ও অন্যান্য উপকরণ’-এ আবার অর্থনীতি। দুই শিক্ষাদাতার দু’টি মন্তব্য রাখা যায়। এক, ‘পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলগুলিতে মানুষের অবস্থা এতটাই খারাপ যে তাদের অনেকের কাছেই জামাকাপড় প্রায় একরকম নেই বললেই চলে’। দুই, ‘শিশুরা আধছেঁড়া জামা গায়ে বিদ্যালয়ে আসছে, পায়ে নেই চটি, শীর্ণ শরীর— এমনই একটা পরিস্থিতি, যা শিশুদের উপর প্রভাব ফেলে।’
পরবর্তী আর একটি অধ্যায় ‘শিশু স্বাস্থ্য’। পুনরায় অর্থনীতি। প্রতিবেদন নির্মাতাদের পর্যবেক্ষণ: ‘গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির বেশির ভাগ শিশুই আসে একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি থেকে। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তাদের জোটে না।’
‘মানুষের ভূমিকা’ অধ্যায়ে তাই উল্লেখ থাকছে অভিভাবকদের প্রশ্ন: ‘লেখাপড়া শিখে কী হবে?’ এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টায় নয়, এমনতর প্রশ্নের প্রস্তুতিপর্ব ব্যাখ্যায় এই বই যাঁরা বানিয়েছেন, তাঁরা বলেই দিলেন: এমন সব অভিভাবক-পড়ুয়া পরিবারের ‘জৈবিক বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাটি কেড়ে নেওয়া হয়েছে’।
এমন অবস্থানে দাঁড়িয়ে শিক্ষা-আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমী কর্মী, এই বইটির সম্পাদককে তাঁর বইতে লিখে ফেলতে হল ‘বিদ্যালয় ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রশাসন নিয়ে যে একটা সামাজিক গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠা দরকার, সেটা কাম্য মাত্রায় পৌঁছতে পারল না।’ এমন মন্তব্যের মধ্যে থেকে যাওয়া প্রশ্ন ‘কেন?’ উত্তর মেলেনি সরাসরি বক্তব্যে। উত্তর রেখে দেওয়া আছে বইটিতেই।
বলা আছে অভিভাবকদের সভায় অভিভাবকরা আসেন না। অন্য ভাবে বলা যায়, এসে কী হবে, তাদের কথা কে জানতে চায়। বলা আছে: বিভিন্ন স্কুল/শিক্ষা কমিটিতে শুধু প্রভাবশালী দলীয় সদস্যদের আগ্রহ। এবং আগ্রহ শিক্ষা বিষয়ে নয়, আর্থিক বিষয়ে। আবার সেই অর্থনীতি। শিক্ষার দলীয় রাজনীতিকরণ। রাজনীতির আর্থনীতিকরণ। তবে কি শিক্ষা এখন নিছক আর্থনীতিক বিষয়? পড়ুয়াদের অর্থনীতিতে না-থাকা আর প্রশাসকদের শুধুই আর্থনীতিক প্রাপ্তিতে থাকা।
বইটির প্রথম দিকে ঘোষণা আছে: শিক্ষিকা-শিক্ষকদের লেখাগুলি থেকে উঠে আসে দু’টি প্রধান এবং পরস্পরবিরোধী ধারা— পশ্চিমবাংলার প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতির দিক আর পিছিয়ে থাকা দিক। বইটি পড়া শেষ করে এমন গুরুতর বিষয়ের গম্ভীর আলোচনাপ্রান্তে রসিকতা করার সুযোগ নিয়ে নিলাম। দু’টি ধারা পরস্পরবিরোধী নয়, সমার্থক। পড়তে আসাদের পিছিয়ে রাখায় পড়ানোর প্রশাসন থেকে করে-খাওয়াদের এগিয়ে যাওয়া। শিক্ষা প্রশাসন থেকে করে-খাওয়ায় শিক্ষায় আসতে চাওয়াদের পিছিয়ে রাখা। ফিচলেমি শেষে আবার গম্ভীর হওয়া। বইটিতে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সমস্যার কথা আছে, আবার আলোচনার প্রচলিত ঢঙ মেনে সমাধানের কথাও রয়েছে। রয়েছে চার ধরনের সমাধানের কথা।
১) এক জন শিক্ষিকা-শিক্ষকের ব্যক্তিগত উদ্যোগ।
২) শিক্ষিকা-শিক্ষকদের পেশাগত/গোষ্ঠীগত উদ্যোগ।
৩) এলাকাগত/সমাজগত উদ্যোগ।

আর
৪) প্রশাসনগত উদ্যোগ।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে আমাদের অনুভব এমন সব উদ্যোগ সম্ভব শিক্ষা একটি স্বাধীন, স্বনির্ভর ক্ষেত্র হলে। কিন্তু আলোচনায় প্রকাশিত শিক্ষা অর্থনীতি-নির্ভর। যদি এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হয়, তা হলে সমাধান ১,২,৩-এর সম্ভাবনা থাকে না। তখন শুধুই সমাধান ৪। অথচ এই বইটি যাঁরা বানিয়েছেন, তাঁদের চাওয়া ‘সামাজিক গণ-আন্দোলন’ উদ্যোগ ১,২,৩-নির্ভর। তখন শিক্ষা অর্থনীতি-নির্ভর নয়। তখন শিক্ষা সামাজিক গণ-আন্দোলনের বিষয়। আর তখন বই নির্মাতাদের মতোই আলোচকের কাছে শিক্ষা আর্থনীতিক বিষয় নয়, রাজনীতিক বিষয়। প্রকৃত অর্থে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.