হাল ফিরবে কবে
যন্ত্রণার ফেরি
রকার বদলেছে। বদলে গিয়েছেন প্রশাসকও। তবু অবহেলার ছবিটা পাল্টায়নি এতটুকুও। ভাঙাচোরা জেটি, লঞ্চের শোচনীয় হাল আর অনিয়মিত দেখভালের ট্র্যাডিশন অব্যাহত হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমিতির। বেশ কিছু দুর্ঘটনাতেও হুঁশ ফেরেনি। বেহাল পরিকাঠামো নিয়েই দিনের পর দিন হাজার হাজার যাত্রী পরিবহণ চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থা। যাত্রীদের অভিযোগ, পরিবর্তনের পরে সংস্থার নির্বাচিত বোর্ড ভেঙে দিয়ে সরকারি প্রশাসককে মুখ্য প্রশাসকের (অ্যাডমিনিস্ট্রেটেটর) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজে ঢিলেমির ছবিটা একই রকম।
দিন কয়েক আগেই সন্ধ্যায় যাত্রীবোঝাই একটি লঞ্চ বাবুঘাট থেকে রামকৃষ্ণপুর লঞ্চঘাট যাওয়ার পথে মাঝনদীতে প্রবল ভাবে দুলতে শুরু করে। আতঙ্কিত যাত্রীরা হুড়োহুড়ি শুরু করেন। কার্যত প্রাণ হাতে করে বাকি পথটুকু যেতে হয় বলে অভিযোগ। লঞ্চচালকের বক্তব্য, ‘‘প্রপেলার ঠিকমতো কাজ না করায় এই দুর্বিপাক।’’ অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি। কারণ, হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমিতির বক্তব্য, বাবুঘাট ও রামকৃষ্ণপুরের মধ্যে যে ফেরিসার্ভিস চলে, সেই কাঠের লঞ্চগুলির সব ক’টি ভাড়া করা। তেল খরচ বাদে প্রতি লঞ্চ পিছু মাসে ১৫ হাজার টাকা করে ভাড়া দেওয়া হয়। তাই মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব লঞ্চ মালিকদের, সংস্থার নয়। কিন্তু লঞ্চগুলি যাত্রী পরিবহণের উপযুক্ত কি না, সেটা দেখভাল করবে কে? সংস্থার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের দাবি, নিয়ম মেনেই সার্ভে হয়। যদিও সংস্থার কর্মীদেরই একাংশ জানালেন, গাফিলতি রয়েছে সার্ভের কাজে।
১৯৯৫ সালে মেরামতির গাফিলতিতে নাজিরগঞ্জ জেটি দু’টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়েছিল। জলে ডুবে মৃত্যু হয় ৩০ জন যাত্রীর। সেই নাজিরগঞ্জ লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা গেল, জেটির কাঠের পাটাতন এখনও জরাজীর্ণ। লোহার প্লেট মরচে ধরে ঝাঁঝরা। জেটির লোহার কাঠামোয় দীর্ঘদিন রঙের প্রলেপ পড়েনি। রেলিংও বেশির ভাগ জায়গায় ভাঙাচোরা। কোথাও কোথাও রেলিংই উধাও। অথচ শনি-রবিবার মেটিয়াবুরুজ হাটের জন্য এই লঞ্চঘাটে তিলধারণের জায়গা থাকে না। মেটিয়াবুরুজ ফেরিঘাটে জেটির অবস্থাও করুণ। কাঠের সিঁড়িগুলো নড়ছে। হাট-যাত্রী মিন্টু নস্কর, প্রদীপ রায়, শেখ রাজারা বললেন, ‘‘চোখের সামনেই দেখছেন তো, জেটিতে যাত্রী-শেডের টিনের ছাউনি ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। বৃষ্টির সময়ে আশ্রয় পাওয়ার জো নেই।”
এত অবহেলা কেন?
নাজিরগঞ্জ লঞ্চঘাটের ইনচার্জ শেখ সোহরাবুদ্দিন বলেন, ‘চার-পাঁচ বছর হল জেটির কোনও মেরামতি হচ্ছে না। ১৯৯৫ সালে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জেটি ভাঙার দায়ে আমাকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। সেই মামলা এখনও চলছে। কিন্তু সেই সময়েও জেটির দুরবস্থার কথা বহু বার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গোচরে এনেছিলাম। এখনও বলে চলেছি। কিন্তু কাজের কাজ হল কই! সব সময়েই আতঙ্কে থাকি।’’
গত বছর ষাঁড়াষাঁড়ি বানের সময়ে বজবজের জেটিটি ভেঙে গিয়েছিল। তবে কোনও প্রাণহানি হয়নি। রামকৃষ্ণপুরের জেটির কাঠে ফাঁক ধরেছে। হাঁটলে ঢকঢক শব্দ হয়। বাবুঘাটের জেটিরও একই হাল। অফিসযাত্রী শৈলেন ঘোষ, রিতা দাস, আসপান জানকী রাও-রা বললেন, ‘‘কাঠের সিঁড়িগুলো ভেঙেচুরে গিয়েছে। দুর্ঘটনা যে কোনও সময়েই হতে পারে।’’ একই ছবি শিবপুর, আর্মেনিয়ান ঘাট, বাগবাজার, শোভাবাজারের জেটিতেও। পোদরা, রাজাবাগানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমিতি ফেরি পরিষেবা দিলেও এখনও জেটি করে উঠতে পারেনি। নিত্যযাত্রী শেখ শাহজাহান, নূর আলম বেগরা বলেন, ‘‘লঞ্চ ঘাটে ভিড়লে কাঠের পাটাতন ফেলে দেওয়া হয়। মহিলা, বাচ্চা ও বয়স্কদের যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে ওঠা-নামা করতে হয়। বেশ কয়েক বার দুর্ঘটনাও ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বেশ কয়েক বার অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি।’’
নাজিরগঞ্জ ও মেটিয়াবুরুজের মধ্যে যাতায়াত করে চারটি লঞ্চ। এর মধ্যে এম ভি জলযাত্রা, এম ভি জনমুক্তি, এম ভি জনশক্তি লঞ্চ তিনটির অবস্থা খুবই খারাপ। রেলিং হেলে রয়েছে। রঙের প্রলেপও পড়েনি দীর্ঘদিন। টিনের ছাউনি ফুটো। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক, সংস্থার এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী জানালেন, সংস্থার নিজস্ব কুড়িটি লঞ্চের মধ্যে দশটি লঞ্চেরই খারাপ অবস্থা। বহু লঞ্চের সার্ভে নিয়ম মেনে হয় না। তাপ্পি বা জোড়াতালি দিয়ে কোনও মতে কাজ চলছে। তাই যাত্রী নিরাপত্তা অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে। এখন সবচেয়ে বেশি যাত্রী হয় হাওড়া থেকে বাবুঘাট রুটে, প্রতি দিন গড়ে প্রায় কুড়ি হাজার। নাজিরগঞ্জ ও মেটিয়াবুরুজ ফেরিঘাটে শনি ও রবিবার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রামকৃষ্ণপুর, শিবপুর, আর্মেনিয়ান, ফেয়ারলি প্লেস, বাগবাজার, শোভাবাজার, পোদরা, রাজাবাগান, বজবজ, বাউড়িয়া, গাদিয়াড়া, নূরপুরের লঞ্চঘাটগুলিতে প্রতি দিন লক্ষাধিক যাত্রী যাতায়াত করেন। পারাপারের টিকিটের দাম চার টাকা।
তার পরেও ১৯৯৫ সালে ভেঙে পড়া জেটির মেরামতি হয়নি এখনও। বাকি ঘাটগুলিতেও অবস্থা তথৈবচ। লঞ্চগুলিও যখন-তখন দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। রক্ষণাবেক্ষণের এই হাল কেন?
হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমিতির প্রাক্তন চেয়ারম্যান লগ্নদেব সিংহের অবশ্য দাবি, “আমার সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়মিতই হত। এখন আমি এই সংস্থার দায়িত্বে নেই। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না।”
একই বক্তব্য সংস্থার বর্তমান প্রশাসক অপরেশ ঘোষেরও। তিনিও দাবি করেন, “কোনও কোনও জেটির মেরামতির প্রয়োজন আছে ঠিকই। তবে লঞ্চ ও জেটির সার্ভের কাজ ঠিক সময়েই হয়।” তবে সংস্থার দুই সহকারী ম্যানেজার দেবনারায়ণ মণ্ডল ও বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর মতে, “ভূতল পরিবহণ সংস্থা হাওড়া থেকে ফেয়ারলি প্লেস ও বাবুঘাটে লঞ্চ-পরিষেবা চালু করার পরে আমাদের যাত্রী সংখ্যা বেশ কিছুটা কমেছে। স্ট্র্যান্ড রোডে ওয়ানওয়ে ব্যবস্থা চালু হওয়াও যাত্রী কমার আর একটি কারণ। ফলে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্কট বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।” আর্থিক সঙ্কটের এই যুক্তি অবশ্য অপরেশবাবু মানতে চাননি।
লঞ্চ ও জেটির বেহাল দশার কথা মেনে নিয়ে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “এত দিন অভ্যন্তরীণ জল পরিবহণ দফতরটি মন্ত্রী হায়দর আজিজ সফি-র অধীনে ছিল। দিন কয়েক হল দফতরটির ভার আমাকে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা ও হাওড়ার দিকে বেশির ভাগ জেটিরই খারাপ অবস্থার কথা জানি। এ ব্যাপারে বিভাগীয় কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সমস্ত ফাইল পনেরো দিনের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। শীঘ্রই জেটিগুলির পরিদর্শনে যাব এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেব।”
হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমিতির রক্ষণাবেক্ষণ শাখার ইনচার্জ শ্যামল নাথ বলেন, ‘‘যে সব জেটি ও লঞ্চের রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন, সেই তালিকা অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি আমার সঙ্গে পরিদর্শনে যাবেন বলে কথা হয়েছে।’’




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.