|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
শিল্পীর ভাবনায় প্রতিফলিত হয় এই শহরের বিপন্নতা |
সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল হিরণ মিত্রের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
হিরণ মিত্র দৃশ্যকলার নানা দিক নিয়ে নিরন্তর চর্চা করেন। ছবি, ভাস্কর্য, স্থাপনা-শিল্প বা ইনস্টলেশন এ সমস্ত ললিত শিল্পে যেমন তিনি কাজ করে আসছেন বিগত প্রায় ৪০ বছর ধরে, তেমনই পাশাপাশি গ্রন্থচিত্রণ, প্রচ্ছদশিল্প, অলঙ্করণের নানা কাজ, নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা ইত্যাদি নানা ফলিত শিল্পেও তাঁর সৃজনপ্রক্রিয়া নানা ধারায় ও নানা মাত্রায় প্রসারিত। লেখক হিসেবেও ইদানীং তিনি যথেষ্ট অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন। তাঁর লেখার মধ্যে কবিতার অনুরণন থাকে। সেই অনুরণন অনুভব করা যায় তাঁর ছবিতেও। এ সমস্ত মিলে সৃজনের ক্ষেত্রে বিশেষ এক ঘরানা তিনি তৈরি করেছেন। দৃশ্যকলায় তাঁর প্রকাশরীতি বিমূর্ততা-সংলগ্ন। সেই বিমূর্ততারও এক বিশেষ ধরন আছে। যাকে বলা যেতে পারে জ্যামিতি-সম্পৃক্ত সাংকেতিক। প্রকৃতি-লগ্ন বা জৈব এবং জ্যামিতিক এই দু’টি ধারায় যদি চিত্রের বিমূর্ততার অভিজ্ঞানকে বিভাজিত করা যায়, তাহলে তাঁর প্রকাশকে দ্বিতীয় ধারার অন্তর্গত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাঁর সমস্ত কাজই জীবন-সম্পৃক্ত ও দায়বোধে অন্বিত।
বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একক প্রদর্শনীতে তাঁর সৃজনের এই বৈশিষ্ট্যগুলিই স্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। প্রায় ৫০টি নানা ধরনের কাজ নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম- ‘আরবানিয়া’। কলকাতার নাগরিক জীবনের অন্তঃস্থ সংকট নানা সংকেতে প্রতিফলিত হয়েছে এই রচনাগুলিতে। দৃশ্যকে তিনি কবিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উপস্থাপিত করেছেন। তাতে বিশেষ এক চরিত্র পেয়েছে তাঁর ছবি, ভাস্কর্য বা ইনস্টলেশন। এই শহরের নিসর্গ ও হৃৎস্পন্দনকে তিনি রঙে-রেখায় দ্বিমাত্রিক ভাবে তুলে ধরেছেন। প্রদর্শনীর স্মারকপত্রে তাঁর পরিকল্পনাকে ব্যক্ত করেছেন এ ভাবে “শহর, শহর ও শহর, রাজপথ, অলিগলি, ঢ্যাঙা বাড়ি, তার ছায়া, স্যাঁতসেঁতে হারিয়ে যাওয়া রাস্তা, হাওয়ায় ওড়া কাপড়, তারে ঝুলছে মরা কাক।... কুয়াশা, বিজ্ঞাপন গোল গম্বুজ, নিশানা ওড়া মোবাইল টাওয়ার। গাড়ির হর্ন, ক্যাকোফোনি, বাজার-শব্দ, দর-কষাকষি কিছুই শোনা যায় না। রেখা ক্রমাগত বিছাতেই থাকে। রঙ ক্রমাগত গড়াতেই থাকে। আকার অচেনা হয়।’’ এটুকু ভূমিকায় হিরণ তাঁর ছবির ভাব ও আঙ্গিক দুটোকেই বোঝাতে পেরেছেন। দৃশ্যকে এ ভাবে সংকেতে পরিণত করা তাঁর ছবির একটি বৈশিষ্ট্য। তাঁর ছবির প্রকরণ সম্পর্কেও তিনি সংক্ষেপে বলেছেন এ ভাবে ‘ক্যাম্বিসের উপর আড়াইমাত্রিক কাজ, বালির আস্তর, কাপড়, স্টাইরোফোম, দড়ি ইত্যাদি, সঙ্গে তেল ও অ্যাক্রিলিক রঙ, সিন্থেটিক স্প্রে।’ |
|
শিল্পী: হিরণ মিত্র |
তাঁর ছবি সাধারণত বর্ণবিরল। সাদা ও কালো এই দুই বিপরীত রঙের সংঘাতের ভিতর দিয়ে এবং কালোকে ভেঙে ভেঙে ধূসরের নানা মাত্রায় বিশ্লেষণ করে তিনি সাধারণত তাঁর অভিষ্ট রূপ নির্মাণ করে থাকেন। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলিতে অবশ্য তিনি এই দুটি চরম বর্ণ ছাড়া অন্য রংও ব্যবহার করেছেন কিছু কিছু লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি। কিন্তু তাদের উজ্জ্বলতাকে তিনি কমিয়ে এনেছেন, বিষণ্ণ এক ছায়ার আবেশ এনেছেন তাদের মধ্যে। যাতে তারা অন্ধকারেই নানা মাত্রার ব্যঞ্জনা আনে। যেমন একটি ছবির সঙ্গে তিনি রঙের বৈশিষ্ট্য ব্যক্ত করেছেন এ ভাবে- ‘সমান্তরাল রঙ, লাল আর সবুজ, আবার প্রতি-রঙও বটে, শুয়ে আছে শ্মশানের নিস্তব্ধতায়, নীচে বিছানো আছে ইতিহাস।’ শহরের জঙ্গমতার ভিতর, উচ্চকিত কলরবের ভিতর তিনি অনুভব করেছেন এক নেতিময় ‘শ্মশানের নিস্তব্ধতা’। এই অনিকেত স্তব্ধতাকেই জ্যামিতির নানা বিন্যাসে দ্বিমাত্রিক ভাবে তিনি রূপান্তরিত করেছেন। তাঁর ভাষায়
‘রেলিং-এর ছায়া, দেওয়ালের ছায়া,
অলিন্দ, ঘুলঘুলি, পাখির বাসা,
খড়কুটো
এরা কি বাসা হারিয়েছে?’
ছবি ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি ভাস্কর্যধর্মী রচনা এবং মেঝেতে ছড়ানো তিনটি ইনস্টলেশন। একটি ভাস্কর্যে সম্পূর্ণ কালোতে রূপায়িত হয়েছে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মানুষের রূপাবয়ব। ছায়াসদৃশ এই মূর্তি অনেকটা যেন প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। হয়ে ওঠে এই শহরের ঘনীভূত স্তব্ধতার এক আর্কিটাইপ। তিনটি রয়েছে ইনস্টলেশন। গ্যালারির অনুষঙ্গে রচিত। যাকে বলা যেতে পারে ‘সাইট-স্পেসিফিক’। তিনটিই সাদা-কালোর বিন্যাসে করা। মেঝেতে বিছানো রয়েছে কালো চাদর। অনেকটা পরিসর জুড়ে। দু’টি আয়তাকার। একটি বৃত্তাকার। তার উপর ছড়ানো রয়েছে অজস্র সাদা আলোকপুঞ্জ। ত্রিমাত্রিক এই ডিজাইনের ভিতর দিয়ে পরোক্ষে আভাসিত হয় শহরের এক বিমূর্ত মানচিত্র। এ ভাবে ‘আরবানিয়া’তে হিরণ মিত্র শহরের ছায়াচ্ছন্ন বিপন্নতাকে তুলে ধরেছেন নানা আঙ্গিকে, ভাবনার বিন্যাসে। |
|
|
|
|
|