পাটবীজের চাষ আর তাকে ঘিরেই পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় মাওবাদী সমস্যা মোকাবিলায় ‘নতুন দিশা’ খুঁজছে রাজ্য সরকার।
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের ঢাল বরাবর বাঘমুণ্ডি, চড়িদা, চানো, শরাকডি, ভুড়সার মতো গ্রামের বহু বাসিন্দা এখন সরকারি সাহায্যে পাটবীজ উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চড়িদার প্রধানচন্দ্র রায় অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে নিজের ২৫ বিঘা জমি দেখিয়ে বলেন, ‘‘পরিস্থিতির চাপে এক সময় অতি-বাম রাজনীতি সমর্থন করতাম। আমার জমি আছে। কিন্তু ফসল তেমন কিছু হয় না। কৃষি বিজ্ঞানীরা আমার জমিতে পাটবীজ উৎপাদন করার পরামর্শ দিয়েছেন। রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। এখন ওই চাষই করব।”
পুরুলিয়ারই করুণাকুমার মাঝি, রবিদাস রায়, বুদ্ধেশ্বর কৈবর্ত বা দিলীপ প্রামাণিকেরা বলেন, ‘‘চাষ করে যদি লাভ হয় তা হলে কি কেউ অস্ত্র ধরে? সরকার পাটবীজের নির্দিষ্ট দামের বাজার দিচ্ছে জেনেই আমরা পাটবীজ উৎপাদনে রাজি হয়েছি।” |
কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “কেন্দ্রীয় পাট ও সহযোগী তন্তু গবেষণা সংস্থার অধিকর্তার নেতৃত্বে জঙ্গলমহলে উন্নত মানের পাটবীজ উৎপাদনের যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তা সফল হলে ওই এলাকায় অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। এ ধরনের আয়ের উৎস থাকলে মাওবাদীরা অস্ত্র ছেড়ে চাষে ফিরবে বলেও আমরা আশা করছি।”
এ রাজ্যে উন্নতমানের পাটবীজ উৎপাদনে পরীক্ষামূলক সাফল্য মিলেছে বর্ধমানের বুদবুদে কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের খামারে। কিন্তু পাটবীজ ফলানোর প্রকল্প শুরু হতে চলেছে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার রুক্ষ জমিতে। সরকারি কর্তারা জানাচ্ছেন, এই চাষের জন্য ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত সুবিধা পুরুলিয়া-বাঁকুড়াতেও রয়েছে। কিন্তু এই দুই জেলার রুক্ষ জমিতে ধান চাষ করে কৃষিজীবীদের আয় অন্য জেলার তুলনায় নগণ্য। পাটবীজ উৎপাদন করে তাঁদের আয় বাড়বে। মাওবাদী-উপদ্রুত এই জেলাগুলিতে যে বর্ধিত আয় স্থানীয় বাসিন্দাদের সমাজের ‘মূলস্রোতে’ থাকতে উৎসাহিত করবে বলে মনে করছে সরকার।
পাট চাষে অগ্রণী রাজ্য হলেও পাটবীজের জন্য পশ্চিমবঙ্গকে মহারাষ্ট্র কিংবা অন্ধপ্রদেশের উপরেই নির্ভর করতে হয়। দালালের হাত ঘুরে সেই বীজ যখন এ রাজ্যে পৌঁছয়, তখন দাম বাড়ে অনেকটাই। পশ্চিমবঙ্গে পাটবীজ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করে পাটচাষের উৎপাদন খরচ কমাতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। মন্ত্রীও বলেন, “পাট এ রাজ্যের প্রধান অর্থকরী ফসল। কিন্তু ফড়েদের উৎপাতে এই ফসলের উৎপাদনের খরচের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্য নেই।”
কেন্দ্রীয় পাট ও সহযোগী তন্তু গবেষণা সংস্থার কৃষিবিজ্ঞানীরা এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। রাজ্য কৃষি দফতর সূত্রের খবর, সরকারি অর্থানুকূল্যে চাষিদের বীজ-সার প্রভৃতি দেওয়া হবে। উৎপাদনের পরে ৭২ টাকা কেজি দরে সেই বীজ চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি কিনে নেবে রাজ্য সরকার। ধান চাষ করে যে প্রান্তিক চাষি বিঘা-প্রতি মেরেকেটে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করতেন, পাটবীজ উৎপাদন করে এই দুই জেলায় প্রতি বিঘায় ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হতে পারে বলে জানিয়েছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। চলতি মাসের মাঝামাঝি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে পুরুলিয়া আসার কথা কৃষিমন্ত্রীর। কৃষি বিকাশ যোজনায় চাষিদের বীজ ও সার দেওয়ার জন্য প্রাথমিক ভাবে ৩ কোটি টাকা অনুমোদনও হয়েছে। কেন্দ্রীয় পাট ও সহযোগী তন্তু গবেষণা সংস্থার অধিকর্তা বিকাশ সিংহ মহাপাত্র বলেন, ‘‘এই কর্মসূচি সফল হলে এখানেও সবুজ বিপ্লব হবে।’’ সেই ‘নতুন বিপ্লবের’ দিকেই এখন তাকিয়ে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল। |