বন্যা ঠেকাতে নির্দেশ দিলেন। পরে নিজেই ভাসলেন ‘বন্যা’য়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভরা বর্ষায় জলপাইগুড়িতে ‘মিনি মহাকরণ’ বসলে আলোচনায় তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকার বন্যা রোখার বিষয়ই অগ্রাধিকার পাওয়ারই কথা। তাই-ই হল। এ বার উত্তরবঙ্গে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। সে কথা মাথায় রেখে মঙ্গলবার প্রশাসনিক বৈঠকে নদী-বাঁধের নজরদারি বাড়ানো ও নিচু এলাকায় বসবাসকারীদের যাতে বিপাকে পড়তে না হয়, সে ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা জারির নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সেই বৈঠক থেকে বেরিয়ে কোচবিহারের দিকে রওনা হতে গিয়ে ‘মানুষের বন্যায়’ থমকে গেল তাঁর গাড়ি।
হু-হু করে ধেয়ে আসা আবালবৃদ্ধবণিতার ঢল সামাল দিতে নিরাপত্তা বিধির তোয়াক্কা না করে গাড়ি থেকে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাস্তায় নেমে পড়লেন। কার্যত জনস্রোতে ভেসেই প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে কোনও রকমে গাড়িতে উঠতে হল তাঁকে। তখনও গাড়ির চারদিকে ছুটছেন শ’য়ে-শ’য়ে তরুণ-তরুণী। কেউ এক বার হাত মেলাতে চান। কেউ চান, নিজের দুর্দশার কথা বলতে। সে দিকে তাকিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গেল, “ভাববেন না। আমি আবার ১৮ অগস্ট আসব। আবার দেখা হবে। আপনাদের কথা শোনার চেষ্টা করব।”
ঘটনা হল, জলপাইগুড়িতে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে যে এমন বাঁধভাঙা ‘উচ্ছ্বাস’ হতে পারে তা পুলিশ-প্রশাসন আঁচই করতে পারেনি। কারণ, একদা বাম-দুর্গ হিসেবে পরিচিত জলপাইগুড়ি শহরে এখনও তৃণমূল ততটা ‘শক্তিশালী’ নয়। তুলনায় সিপিএম ও কংগ্রেসের সংগঠন শহরে জোরদার। সেখানে এমন জন-উচ্ছ্বাসের কারণ কী? পুলিশ-প্রশাসনের প্রবীণ অফিসারেরা কিংবা নানা রাজনৈতিক দলের অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের অনেকেরই মত, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এটিই প্রথম জলপাইগুড়ি সফর। সেটা হয়তো প্রথম কারণ। দ্বিতীয়ত, আর্ট গ্যালারিতে প্রশাসনিক বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী অগস্ট মাসে সার্কিট বেঞ্চ চালু করানোর চেষ্টার কথা ঘোষণা করায় জলপাইগুড়িবাসী পথে নামতে দেরি করেননি। কারণ, শিলিগুড়ি না জলপাইগুড়ি কোথায় সার্কিট বেঞ্চ হবে তা নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, সেই সময়ে যত ক’টি কেন্দ্রীয় কিংবা রাজ্যের প্রতিনিধি দল পরিদর্শনে গিয়েছে, শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানাতে জলপাইগুড়ির রাস্তায় উপচে পড়েছে ভিড়। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের কথায়, “অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন। কিন্তু এক বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী যে কাজ করে চলেছেন, তা কতটা সাধারণ মানুষের কাছে সমাদৃত হচ্ছে সেটাই এ দিন স্পষ্ট হয়েছে।”
বাগডোগরায় এ দিন দুপুরে পৌঁছে মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি চলে যান জলপাইগুড়ি আর্ট গ্যালারিতে। সেখানে ততক্ষণে হাজির মুখ্যসচিব সমর ঘোষ, রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়-সহ ২৩ জন প্রশাসনিক-কর্তা। উপস্থিত ছিলেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব, বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনও। জেলা পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ কর্তা থেকে নিচুতলার অফিসারেরাও সেখানে ছিলেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, পরিচয় পর্বের পরে মুখ্যমন্ত্রী রাস্তাঘাট, নানাবিধ সরকারি প্রকল্প, স্কুল-কলেজে, হাসপাতালের পরিস্থিতি ও সমস্যার ব্যাপারে জানতে চান। একাধিক ক্ষেত্রে মঞ্চে উপস্থিত সচিবদের তখনই সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ জারি করতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, ‘শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ (এসজেডিএ) যে ভাবে দ্রুতগতিতে ‘ফিল্ম সিটি’ তৈরির জন্য জমি তৈরি করে দিয়েছে তারও প্রশংসা করেন মুখ্যমন্ত্রী। এসজেডিএ-এর চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসায় আমরা গর্বিত। ফিল্ম সিটি গড়ে উঠলে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে।” |