সিপিএমের পার্টি অফিসে ঢুকে প্রাক্তন মন্ত্রী ও বর্তমান বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লা-সহ দলের নেতা-কর্মীদের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার দুপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের ঘটনা। রেজ্জাকের দাবি, তাঁর উপরে চড়াও হয়েছিল এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক তথা তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের লোকজন। আরাবুল অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
সিপিএমের দাবি ‘হামলায়’ তাদের সাত জন জখম হন। ১০ তৃণমূল কর্মী-সহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে কাশীপুর থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। রাতে কাশীপুর থানায় যান পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী। ভাঙড় এলাকার কাশীপুর থানার বিজয়গঞ্জের পার্টি অফিসে কৃষকসভার ওই বৈঠকে রেজ্জাক মোল্লা ছাড়াও ভাঙড়ের সিপিএম বিধায়ক বাদল জমাদার, সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তুষার ঘোষের মতো নেতারা হাজির ছিলেন। ছিলেন প্রায় আড়াইশো কর্মী-সমর্থকও। সিপিএমের অভিযোগ, বৈঠক চলাকালীন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ তৃণমূলের সশস্ত্র একটি দল ওই পার্টি অফিসের সামনে বোমা ফাটায়। অফিসে ঢুকে তারা কার্যত তাণ্ডব চালায়। সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের ‘বেধড়ক মারধর’ করে। অধিকাংশ সিপিএম সমর্থকই পালিয়ে যান। |
রেজ্জাক মোল্লা, বাদল জমাদার ও তুষার ঘোষ তখনও পার্টি অফিসে ছিলেন। রেজ্জাকের অভিযোগ, “এলাকার চাষিরা তৃণমূলের অত্যাচারের বিষয়ে আমাদের কাছে বলছিলেন। তখনই হামলা শুরু। তৃণমূলের দু’টি ছেলে এসে প্রথমে আমার মাথা তাক করে বাঁশের বাড়ি মারে। আমি মাথা সরানোয় ঘা-টা পড়ে টেবিলের উপরে। ওরা আমাদের দিকে রিভলভার তাক করে বলে, ‘ভাঙড়-২ ব্লক আরাবুল ইসলামের এলাকা। পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত এই এলাকায় ঢুকবেন না’। আমাদেরকে প্রায় ধাক্কা দিতে দিতে পার্টি অফিস থেকে বার করে দেওয়া হয়।” হামলাকারীদের মধ্যে দু’টি ছেলেকে তিনি চেনেন বলে পুলিশের কাছে জানান প্রাক্তন মন্ত্রী। তাঁর সংযোজন, “আমরা সব রকম লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।”
উত্তরবঙ্গ সফরে থাকা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এ দিন ভাঙড়ের ঘটনার খবর আসে। তিনি পুলিশকে নির্দেশ দেন, তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম ঘটনায় জড়িত থাকলে তাঁকে গ্রেফতার করতে হবে। পরে দলীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, ওখানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে একটি জনসভা থেকে কুৎসিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করা হচ্ছিল। স্থানীয় দোকানদারেরা প্রতিবাদ করলে বচসা বাধে। আরাবুল বা তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব তাতে জড়িত নন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারে-আসা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দলের বিধায়কদের বৈঠকে সোমবার অনুপস্থিত থাকার পরে সিপিএম নেতৃত্বের কাছে নিজের ‘ভাবমূর্তি’ উজ্জ্বল করতেই রেজ্জাকের এই অভিযোগ এমনই তথ্য মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে দলীয় সূত্রে।
পরে মহাকরণে রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সেখানে আরাবুল ছিল না। আমাদের দলেরও কোনও লোক ছিল না।” তিনি বলেন, “একটি সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন রেজ্জাক। খুবই খারাপ ভাষা ব্যবহার করায় স্থানীয় মানুষ প্রতিবাদ করেন। এই নিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে রেজ্জাকরা চলে যান।” ঘটনাস্থলে গিয়ে এ দিন দেখা গিয়েছে, সিপিএমের পার্টি অফিসের সামনে না-ফাটা দেশি বোমা পড়ে রয়েছে। টিউবওয়েলের হাতল ভাঙা। ভিতরের আলমারি তছনছ। বিধায়ক বাদলবাবুর অভিযোগ, আলমারি থেকে বিধায়ক হিসেবে তাঁর সই করা একাধিক প্যাড চুরি গিয়েছে।
বিজয়গঞ্জ অফিস থেকে ভাঙড় পার্টি অফিসে যান ওই সিপিএম নেতারা। সেখানে দলীয় নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “এখানে তৃণমূলের সংগঠনে ধস নেমেছে। সেটা বুঝেই ওরা পঞ্চায়েত ভোটের আগে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে।” তাঁর অভিযোগ, “এটি পরিকল্পিত হামলা।” ঘটনার প্রতিবাদে জেলার বিভিন্ন জায়গায় এ দিন মিছিল করে সিপিএম। কান্তিবাবু জানান, ঘটনার প্রতিবাদে কাল, বৃহস্পতিবার ভাঙড়ের কাঁটালিয়া বাসস্ট্যান্ডে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা বামফ্রন্টের নেতারা প্রতিবাদ সভা করবেন। সেখানে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও থাকবেন।
তৃণমূল নেতা আরাবুল অবশ্য বলেন, “যত দূর জানি, সিপিএমের ওই সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচার করা হচ্ছিল। সেই খবর পেয়ে এলাকার মানুষ হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের যোগ নেই।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও যোগ নেই।”
ঘটনার নিন্দা করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ দিন বলেছেন, “প্রশাসনের কাছে দাবি, তৃণমূলের এই দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে হবে।” বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর বক্তব্য, “পঞ্চায়েত ভোট না-মেটা পর্যন্ত অন্য দলের কেউ কোনও মিটিং-মিছিল করতে পারবেন না বলে ভাঙড়ের প্রাক্তন বিধায়কের নির্দেশ আছে! আক্রমণকারীরা এই কথাই বলেছে বলে খবর পেয়েছি। বিধানসভায় প্রাক্তন বিধায়কদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ভাঙড়ে বর্তমান বিধায়কদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে! এই হচ্ছে রাজ্যের পরিস্থিতি!” |