|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
পড়ছে, কিন্তু কিছুই শিখছে না কেন আমাদের স্কুলের এই হাল |
অনেক কথার ভিড়ে গোড়ার কথাটা হারিয়ে যাচ্ছে। কথাটা হল এই যে, এক জন দু’জন নয়,
পশ্চিমবঙ্গে অগণিত ছাত্রছাত্রী স্কুলে কিছুই শেখে না। অথচ স্কুলশিক্ষা ও শিক্ষকদের জন্য
অনেক কিছুই করা হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার এই মৌলিক সমস্যার কারণ খুঁজেছেন
সুগত মারজিৎ |
কিছু দিন আগে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হওয়ার সুবাদে অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। তিনি এবং এম আই টি-র আরও এক জন গবেষক, এসথার ডুফলো বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের অনেক তথ্য সংগ্রহ করে দেখালেন যে, অধিকাংশ দেশেই মোটামুটি অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রী উঁচু ক্লাসে পাশ করে ওঠে ঠিকই, কিন্তু বিশেষ কিছু শেখে না। পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বহু-আলোচিত প্রামাণ্য গবেষণায় অর্থনীতিবিদ জ্যোৎস্না জালানও এই তথ্যই দেখিয়েছেন। এটা আমাদের শিক্ষার একটা মৌলিক সমস্যা। প্রশ্ন হল, কেন এমনটা ঘটছে? কেন ছাত্রছাত্রীরা পড়ছে, কিন্তু শিখছে না?
কেউ কেউ বলেন, পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার জন্যই এই অবস্থা। কিন্তু পাশ-ফেল তুলে দিলেও ক্লাস পরীক্ষা বা ক্রমাগত মনিটরিংয়ের সাহায্য নেওয়া যাবে না, তা তো নয়। প্রশ্ন হল, সিলেবাস অনুযায়ী যা পড়ানো হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা তা শিখছে না কেন? শিক্ষকশিক্ষিকারা নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছেন, মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা হচ্ছে। মাসের প্রথম দিনে মাইনে পাচ্ছেন, কিন্তু ক্লাস ফোরের ছেলেমেয়েরা ক্লাস ওয়ানের অঙ্ক করতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের নামও লিখতে পারে না। এ তো ভয়ানক ব্যাপার। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাজের ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট সুবিধা দিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ হচ্ছে অনেক। এ ছাড়া, এই সরকার মাস মাইনে ঠিক সময়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন, শিক্ষার অধিকার আইনের যথার্থ বলবৎ করার ব্যবস্থা করেছেন। বিশেষ করে উপদ্রুত অঞ্চল, যেমন জঙ্গলমহলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের জন্য হস্টেল-সহ ২৩টি স্কুলবাড়ি নির্মাণের প্রকল্প শুরু হচ্ছে। পঠনপাঠন পদ্ধতি এবং সিলেবাসের গঠন সংক্রান্ত অনেক নতুন পদক্ষেপ করা হয়েছে। তবুও কেন ছোট ছেলেমেয়েরা যা পড়ছে, তা শিখছে না, সেটা আরও ভাল ভাবে বোঝা প্রয়োজন। |
|
অন্য রকম। মেদিনীপুরের নবোদয় স্কুলে কর্মশালা। মার্চ, ২০১২। ছবি: রমাপ্রসাদ সাউ |
অনেক মা-বাবা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না, স্কুলের ওপর ভরসা করেন, আবার বাধ্য হয়ে প্রাইভেট টিউটরের সাহায্য নেন। শহর-গ্রাম-গঞ্জে এক অবস্থা। এক এক সময় মনে হয়, স্কুল তুলে দিয়ে সরকার শুধু পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করলেই পারে। বাবা-মা, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার এরাই সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দেবে আর ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দেবে, তা হলেই তো হল। স্কুলে যে ভাবে লেখাপড়া করানো হয়, তার হাজার সমস্যা। কতকগুলো বুনিয়াদি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব।
একটা বড় সমস্যা হল হোমওয়ার্ক, বা বাড়ি থেকে লেখাপড়ার কাজ করিয়ে নিয়ে আসা। বলা হচ্ছে, ‘বাড়ি থেকে এটা করে নিয়ে আসবে’ কিংবা ‘ওটা শিখে নেবে’। অর্থাৎ, শিক্ষক-শিক্ষিকারা ‘শেখানো’র দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। গাদা গাদা নতুন জিনিস পুঁটলি পাকিয়ে গিলিয়ে দিচ্ছেন বটে, কিন্তু সেগুলো হজম করাবে বাবা-মা আর প্রাইভেট টিউটর। নার্সারির ছেলেমেয়েদের জন্যও গৃহশিক্ষক-শিক্ষিকার প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু একেবারে গোড়ার দিকে যত গেলানোর চেষ্টা হবে, ছেলেমেয়েদের বুনিয়াদি দক্ষতা একেবারেই পুষ্ট হবে না। আন্টি স্কুলে পড়াবে আর অন্যরা শেখাবে এ এক অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা। প্রাইভেট টিউশনির বাজারও এতে ভীষণ ভাবে পুষ্ট হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এই ব্যবস্থায় সুবিধা লাভ করেন। আর স্কুলে যত কম শিখবে, বেসরকারি শিক্ষার বাজারের প্রসার ঘটবে তত বেশি। এই বেসরকারি শিক্ষার বাজার আজ শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জে প্রসারিত। যাঁরা বেসরকারি সাহায্য নিতে অক্ষম হবেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা নাম লিখতে বা অঙ্ক করতে শিখবে না। শিক্ষা-না-পাওয়া বাবা-মাদের ছেলেমেয়েরা মিড-ডে-মিল পাবে, কিন্তু দু’দিন বাদেই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূরে চলে যাবে। তাই এত মারাত্মক সর্বভারতীয় ড্রপ-আউট রেট। একশো জন স্কুলে ঢুকবে, কলেজে দশের কম।
|
আর পশ্চিমবঙ্গে? |
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে লালিতপালিত হচ্ছে এই অব্যবস্থা। পৃথিবীর অন্য জায়গায় সমস্যা হয়তো আছে, কিন্তু সেটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। আত্মসমালোচনা সব সময় বাঞ্ছনীয়। সংস্কারও। সংস্কারের উদ্যোগটা এক ভাবে শুরু করা যায়। এই মুহূর্তে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সমস্ত স্কুলের মধ্যে থেকে নমুনা সমীক্ষার সাহায্যে নির্দিষ্ট কিছু স্কুলে একটা ব্যাপার নিয়ে পরীক্ষা চালানো যায়। চতুর্থ শ্রেণির ছেলেমেয়েরা প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির অঙ্ক করতে পারে কি না এবং দু’কলম লিখতে পারে কি না। এবং যারা পারে না, তাদের সংখ্যা আনুপাতিক হিসেবে একটি নির্দিষ্ট মানের উপরে হলে সেই সব স্কুলকে চিহ্নিত করে কারণ দর্শাতে বলা। সরকারের অর্থ যে খোলামকুচি নয়, সে বিষয়ে অবহিত করা। এই পদক্ষেপ নিশ্চয় সবাইকে খানিকটা সতর্ক করবে।
সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হল, স্কুলের মধ্যে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা দিনের একটা সময় যা পড়াচ্ছেন, ছেলেমেয়েরা তা শিখছে কি না তা নিয়ে ‘টিউটরিং’ করবেন, মানে বিশেষ ভাবে শেখাবেন। বিশেষ করে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এ ব্যবস্থা আবশ্যিক ভাবে বলবৎ করতে হবে। ক্লাসে যদি কোনও অঙ্ক দেখিয়ে দেওয়া হয়, সেই অঙ্ক ছেলেমেয়েরা করতে পারছে কি না সেটা স্কুলের ভেতরেই যাচাই করে, দরকার হলে আবার শেখাতে হবে। যদি পাঁচ ঘণ্টা স্কুলে থাকতে হয়, তা হলে তিন ঘণ্টা পড়ানো আর দু’ঘণ্টা বিশেষ ভাবে শেখানো এ ব্যবস্থা আনতেই হবে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত হোম-ওয়ার্ক তুলে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। হোম-ওয়ার্ক হয়তো সবাই করবে, কিন্তু বাধ্যতামূলক হবে না। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই স্কুলের মধ্যে হোম-ওয়ার্ক করাবেন। সিলেবাস যদি অন্তরায় হয়, ছোটদের জন্য সিলেবাসের দায়ভার কমাতে হবে। ‘হোমওয়ার্ক’-এর বিধ্বংসী প্রভাব থেকে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের এবং তাদের বাবা-মায়েদের মুক্ত করার প্রয়োজন এড়িয়ে গেলে চলবে না। তাই নীচের দিকে সিলেবাস কাটছাঁট করে একেবারে গোড়ার দক্ষতা, অর্থাৎ ভাষা ও অঙ্ক, এই দুই বিষয়ের ওপর জোর দিতেই হবে। আর এ ধরনের শিক্ষা কার্যকর করতে স্কুলের মধ্যেই শিক্ষক-শিক্ষিকারা টিউটরিং করবেন। শুধু পড়ালে চলবে না, শেখাতে হবে।
বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড, মিড-ডে-মিল, মাস মাইনে, ডি এ, পেনশন সব তো হল, কিন্তু যে ছেলেমেয়েরা কিছুই শিখল না, তাদের কী হবে? সরকার সব করে দিচ্ছেন। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা, আমার ছাত্রছাত্রীরা কিছু শিখছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব সম্পর্কে যদি সচেতনতা না থাকে আর আমার গাফিলতির কোনও শাস্তি যদি না থাকে, তা হলে আপাতদৃষ্টিতে সব ‘ঠিকঠাক’ চললেও সমস্যার নিরসন হবে না।
একটি নতুন ও সাহসী পদক্ষেপ সরকার অনুমোদন করেছে। সার্বিক ও নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে প্রতিটি শিশুর জন্য একটি ‘ডায়েরি’ তৈরি হবে এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা একটি ডায়েরি রাখবেন শিশুদের অগ্রগতি এবং ঘাটতির বিবরণ নথিবদ্ধ করার জন্য। অন্য কোনও জায়গায় এ ধরনের নীতি প্রণয়ন হলে অনেকটাই কাজ হত বলে আমার ধারণা। কিন্তু এ রাজ্যে কর্মসংস্কৃতির ইতিহাস বড় করুণ। কালকে ডায়েরি ঠিক মতো চালু না থাকলে বা ডায়েরিতে যা লেখা হচ্ছে, তার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের ঠিক ভাবে শেখার কোনও সম্পর্ক যদি না থাকে, তা হলে কাকে কী ভাবে শাস্তি দেব আমরা, সেটা ঠিক করে দেওয়া দরকার। বন্ধ সম্পর্কে কড়া মনোভাবের বৈপ্লবিক নীতির ফল দেখছি আমরা। শুধু অন্তরের তাগিদে আমরা ঠিক কাজ করব, এ সম্ভাবনা দূর অস্ত্।
|
অর্থনীতিবিদ, কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর সঙ্গে যুক্ত |
|
|
|
|
|