|
|
|
|
|
|
|
পায়ে পায়ে বিশ্বকাপ |
ইরাক বল পাস করল সোমালিয়াকে, সোমালিয়া থেকে বসনিয়া, বসনিয়া থেকে সার্বিয়া... দুনিয়ার
ঘরছাড়া কিশোর আর তরুণদের নিয়ে আমেরিকার মাটিতে জর্ডনের কন্যা গড়লেন এক
ফুটবল দল। একটা পৃথিবীও। সত্যি হলেও গল্প। শুনিয়েছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
জর্জিয়া। আমেরিকা। ২০০৪। বিকেল হয়েছে। ১৩-১৪ বছর বয়সীদের নিয়ে স্থানীয় লিগের খেলা আরম্ভ হবে। আপাতত মাঠের ধারে গা ঘামাচ্ছে দুই দল। নর্থ অ্যাটলান্টার দলটি টগবগ করে ফুটছে, যেন এই গিলে খাবে প্রতিপক্ষকে। প্রতিপক্ষ বলতে ‘দ্য ফিউজি’স’। দেখে মোটেই সম্ভ্রম জাগে না। কেমন রোগা রোগা, পায়ে ঠিকঠাক বুট নেই, ঢোলা প্যান্ট পরা, ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে সব। হাতে গোনা দর্শকদের প্রায় সব্বাই নর্থ অ্যাটলান্টা প্লেয়ারদের বাবা-মা, আপাতত ব্যস্ত গল্পগুজবে। তাদের আচরণে বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব।
হঠাৎ একটা সাংঘাতিক আওয়াজ। পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, নরম আকাশ চিরে বোমারু বিমানের ঝাঁক, মারকুটে ভাব নিয়ে এগিয়ে আসছে। আসছে আসছে আসছে, হঠাৎ নীচের দিকে একটা ডাইভ মারল, এ কী! মাটি ফুঁড়ে দেবে নাকি? না না, সোঁ করে ওই তো উড়ে গেল আরও উঁচুতে। অকল্পনীয়, মারাত্মক, তুখড়। নীচে তখন হাততালি আর বিস্ময়সূচক আওয়াজের ছড়াছড়ি। সত্যি, দেখলাম বটে!
কেউ কেউ কিন্তু দেখেইনি ও সব। দ্য ফিউজি’স-এর কয়েক জন প্লেয়ার, ওই সময়টা পুরো, ঘাসে মুখ গুঁজে থরথর করে কেঁপে গিয়েছে। ভেবেছে, এই বুঝি গা ঝলসে গেল আগুনে। এ বার তো অন্ধকার হয়ে যাবে চোখ, ছোটবেলার অভ্যেস তো... কিন্তু কই, মা-হারানো চিৎকার এল না তো? উল্টে এল লুমা মুফলে’র কড়কানি। লুমা মুফলে এই দলটার কোচ। হ্যাঁ ছেলেদের ফুটবল টিমের মহিলা কোচ। ‘স্টেডি বয়েজ স্টেডি’, চেঁচালেন লুমা, ‘ঠিক করে ওয়ার্ম আপ করো।’ বিশেষ করে ক্রিশ্চিয়ানকে আরও ধমকানি দিলেন। বললেন, তিন কাঠিতে বল না রাখতে পারলে, আজ আর নিস্তার নেই। চলো, মন দাও।
ক্রিশ্চিয়ান এই দলের মূল ফরওয়ার্ড, লাইবেরিয়ার ছেলে, এখন থাকে অ্যাটলান্টা’র ক্লার্কস্টন শহরে। ঠিক ফিউজি’স-এর বাকিদের মতো। ফিউজি’স আর চারটে দলের মতো নয়, ওদের প্রত্যেকেই রিফিউজি। যুদ্ধকবলিত অঞ্চল থেকে হাতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফেরা সব মানুষ। কেউ কেনিয়ার, কেউ সুদান, মায়ানমার, বসনিয়া, কসোভো, ইরাক, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, ইথিয়োপিয়া, কেউ বা সোমালিয়ার। গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে ওরা সব দৌড়েছিল উদ্ভ্রান্তের মতো। কেউ সদ্য গুলি খাওয়া বাবা’র দেহের ওপর দিয়ে, কেউ কোপ বসানো গলায় ছেঁড়া কাপড় ঠুসে, কেউ সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর নিথর দেহ হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে, আর কেউ অবশ্যই দু’বছরের বাচ্চাকে পেটের টানে মিথ্যে ভুলিয়ে, রাস্তার ধারে বসিয়ে রেখে।
এঁদের অধিকাংশই এসে জমলেন সম্পূর্ণ অচেনা, বিজাতীয় ক্লার্কস্টন- এ। ওঁরা এখানে এলেন ওয়ার্ল্ড রিলিফ বা ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি’র মতো কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার কল্যাণে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের আয়োজন করে তারা। রিফিউজি ক্যাম্প-এর মাছি ভনভনে গন্ধ বেরোনো সীমানায় যখন এই সব সংস্থার লোকজন এসে পৌঁছয়, মুহূর্তেই সেখানে কুৎসিত এক ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যায়। সব্বাই কোনও ক্রমে সামনে দাঁড়াবে। না হলে তো কেউ লক্ষই করবে না, না হলে তো আমেরিকার টিকিট মিলবে না। আমেরিকা...স্বপ্ন...এক বার চলে যাই, দেখিস সব কষ্ট ধীরে ধীরে মিইয়ে যাবে। সারা ক্ষণ এই বলেই তো নিজেকে, নিজের ছেলে-মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছে কেউ।
কারও কারও আশা জল পেল সত্যি। গত জন্মের সমস্ত পাপ ধুয়ে তারা এখন আমেরিকায়, নতুন শুরু। আমেরিকা এত বড় দেশ, সামান্য কয়েক জনের খেয়াল রাখবে না? নিশ্চয়ই রাখবে। অন্তত একটা গাড়ি, ছিমছাম বাড়ি আর অফুরান খাওয়া তো পাওয়া যাবে, আপাতত তাতেই চলবে। তার পর দেখা যাবে। আর এর মধ্যে একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারলে তো কেল্লা ফতে।
কিন্তু প্রথম বাজ পড়ল, যখন শোনা গেল, সরকার দেখবে শুধু তিন মাস, তার পর যাও নিজে করে খাও। আর রিফিউজি ক্যাম্প থেকে আমেরিকা অবধি আসার প্লেনের টিকিটের জন্য যে ধার দেওয়া হয়েছিল, সেটিও শীঘ্রই ফেরত চাইছিল ওই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। ফলে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার আগেই আবার শুরু হয়ে গেল নাকে মুখে গুঁজে দৌড়। আর এক রকম গৃহযুদ্ধ।
|
ক্লার্কস্টন |
বড়, ছোট কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারছে না, কোথায় এগোবে, কখন পিছোবে, কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। লাইবেরিয়ার যে সব বাবা-মা ভেবেছিলেন, যাক বাঁচা গেল, গেরিলা বাহিনী তাঁদের ছেলেকে আর ছিনিয়ে নিতে পারবে না কখনও, তাঁরাই হতভম্ব হয়ে দেখলেন, তাঁদের ছেলে ক্লার্কস্টন-এর নানা গ্যাং-এ সেঁধিয়ে যাচ্ছে, রাতে পাঁউরুটি আর জল আর ভাল্লাগছে না বলে ড্রাগ নিচ্ছে। রাস্তায় বেরোলেই এটা নয় সেটা ঝুটঝামেলা, খামখাই গালিগালাজ করছে যে সে, মেয়েদের বুক ধরে টানছে, এমনকী আইন ভাঙার দায়ে পুলিশও যা-খুশি জরিমানা করছে, ধরে ঠেঙিয়েও দিচ্ছে। কী আইন, কেন আইন, তাই জানে না, জট তো পাকবেই। মোদ্দা কথা, চোখের সামনে জীবনটা আবার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এত দিনের সমস্ত কল্পনা, স্বপ্ন, আশ ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছাই।
আর আগের জীবনও তো অল্পে পিছু ছাড়ে না। তা ভাল বোঝা গেল, যে দিন দুম করে গলির মোড়ে মুখোমুখি হল বসনিয়ার এক দল রিফিউজি ও সার্বিয়ার সেই পুলিশ অফিসার, যে এক কালে মেরে দাঁত ভেঙে পা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। হাওয়ায় ফের বারুদের গন্ধ। সময় অপেক্ষমাণ, টানটান, দৈনন্দিন ধর্ষিতার ন্যায়। |
|
ক্লার্কস্টন-এর বাসিন্দারা আকস্মিক এই জোয়ারের ফলে বানভাসি তখন। কিছু বোঝার আগেই তাদের চার পাশে বোরখা পরা মহিলার ভিড়, ভোরবেলার আজান, ভিয়েতনামি নুডল-এর দোকান, ওষুধের দোকানে আফ্রিকার জড়িবুটি, আর গাড়ির পার্কিং লট-এ কাগজ পলিথিন মুড়ে মুড়ে ফুটবল। মুহূর্তেই শান্ত ছোট্ট খোলামেলা শহরের ধাতটাই বদলে গেল। গেঁয়ো রিফিউজিদের প্রতি প্রাথমিক উষ্মা বদলে গেল ঘেন্নায়, আর তার পর, প্রতিবাদে। বাসিন্দারা সবাই মিলে ঘিরে ধরলেন ওই পুনর্বাসন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলিকে। কেন তারা এখানে এই সব হাড়হাভাতে রিফিউজিগুলোকে এনে বসিয়ে দিয়েছে? জোর তর্ক লেগে গেল। পুনর্বাসন সংস্থার লোকেরা পাল্টা জবাব দিল ক্লার্কস্টন শহরকে তো সবাই বলে ‘স্মল টাউন, বিগ হার্ট’, এই কি তার ছিরি? একটা মরতে বসা লোককে ঠাঁই দেওয়ার মানবিকতা বোধও কি নেই এখানকার লোকেদের? ক্লার্কস্টন এক স্বরে বলল, খুব আছে, কিন্তু মানবিকতার দোহাই দিয়ে এ রকম অসম্ভব উৎপাতের মানে কী? আগে তো ভেবে দেখতে হবে, যার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে এই গুরুদায়িত্ব, সে কি আদৌ কুলোতে পারবে? ক্লার্কস্টন এ ধকল নিতে মোটেই প্রস্তুত নয়। ওঁদের মতে, ক্লার্কস্টন শীঘ্রই নোংরা একটা বস্তিতে পরিণত হচ্ছিল।
অবস্থা অনেকটা একটা ছোট লাইফবোটের মতো, যাকে হঠাৎই একটা বড় জাহাজ থেকে উত্তাল সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ নিজে বাছেনি এই নৌকা, এলোপাথাড়ি নাম ডেকে তাদের পাশাপাশি বসানো হয়েছে। কেউ কাউকে চেনে না, জীবনে দেখেনি, একে অপরের ভাষা জানা নেই, কিন্তু এক সঙ্গে দাঁড় বেয়ে পারে উঠতে হবে। দাঁড় বাইবে কে? ইশারার মানে বুঝবে কে? কোন দিকে ভাসবে, সে সিদ্ধান্ত নেবেই বা কে?
|
লুমা মুফলে |
জর্ডন-এর মেয়ে লুমা। বাবা-মা-ঠাকুমা’র আদুরে মেয়ে। বেশ সম্পন্ন, সুপ্রতিষ্ঠিত বাড়ি ওঁদের। শুরু থেকেই লুমা’র বাবা-মা চাইতেন, মেয়ে উদার, সংস্কারমুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠুক। রাজধানী আম্মান-এর আমেরিকান কমিউনিটি স্কুলে লুমা ঠিক সেই ভাবেই তৈরি হচ্ছিল। যে কোনও ইসলামধর্মী দেশের বাধ্যতামূলক শাসন এড়িয়ে স্কুলে লুমা ছেলেদের মতোই খেলল বাস্কেটবল, ভলিবল, বেসবল, ফুটবল। একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতাও বাসা বাঁধতে লাগল তার ভেতর। এর মধ্যেই অবশ্য লুমাকে পাঠানো হয়েছিল খোদ আমেরিকায়, পড়াশোনার জন্য। চিরকালের বদ্ধ ঘরে চিলতে উদার হাওয়া ঢুকলে যা হয়, এর পর তাই হল। ছারখার। লুমা স্থির করল, স্বদেশের রক্ষণশীল পরিবেশে আর ফিরবে না। একাই লড়ে যাবে ওই দূরদেশে। পরিবারের বাকিরা মেনে নিল না, চিৎকার চেঁচামেচি হল, লুমা’র বাবা সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিলেন, মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, কিন্তু কিছুতেই লুমাকে বাগে আনা গেল না।
কষ্ট হল, দু’পা এগোনো গেল তো তিন পা পিছলে আরও নীচে। সাপোর্ট সিস্টেম বলে যখন কিছুই থাকে না, তখন বেশি দিন টিকে থাকা কঠিনই নয়, অসম্ভব। কিন্তু লুমা যে ছাড়ার পাত্রী নয়। যে সব চাকরি জুটল, সেগুলো তেমন দারুণ কিছু নয়, পাশাপাশি খুচরো ব্যবসাগুলোও ভাল দাঁড়াচ্ছিল না। তবু লুমা বাড়ি ফিরলেন না। স্বেচ্ছায় অভিবাসী হয়ে রয়ে গেলেন।
|
দ্য ফিউজি’স : আইডিয়া |
|
এক দিন শহরে ঘুরতে ঘুরতে লুমা’র গাড়ি থেমেছিল একটি ছোট্ট পার্কিং লট-এ। ফুটবল খেলছিল কয়েক জন ছেলে, এই ১৩-১৪ হবে। সাদা, কালো, বাদামি, সব রকম চেহারা এক সঙ্গে দৌড়চ্ছে একটা ডেলা পাকানো বলের পিছনে। কী ফুর্তি, বলে বোঝানো যাবে না। লুমা’র বেশ আশ্চর্য লাগল, কারা এরা? অনেক দিন পর লুমা’র এত ভাল লাগছিল! ওখানে ঠায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেন লুমা। কিছু একটা খেলে গেল যেন মনে। দু’এক দিন পর লুমা গাড়ি চালিয়ে আবার গেলেন সেখানে। সে দিনও সেই সব ১৩-১৪’রা হাজির। লুমা গাড়ি থেকে একটা নতুন ফুটবল বের করে এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে। বললেন, আমায় খেলতে নেবে? ওরা তো অবাক, বলে কী? ওরা খেলছে ওদের তালে, আর এ কোন পাগল এসে জুটল মাঝে? তার ওপর আবার মেয়ে। ওরা খানিক এড়িয়েই গেল, কিন্তু লুমা আরও কাতর, নিরন্তর। হঠাৎই একটা ছিটকে আসা বল ট্র্যাপ করে সাঁ সাঁ করে কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন ওদের। ওরা তো হাঁ। লুমা আবার ওদের পায়ের ফাঁক দিয়ে বল বের করে নিয়ে চলে গেলেন। ওরা বোকার মতো শুধু চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। হচ্ছেটা কী? হেসে ফেলল ওরা, জড়ো হল লুমা’র চার ধারে, হ্যান্ডশেক এ হাত ও হাত। লুমা পেয়ে গেলেন ওঁর দল।
ধীরে ধীরে আড্ডা জমল ওদের। কঙ্গো, বুরুন্ডি, ভিয়েতনাম, ইরাক, বসনিয়া, নানা ঘরের গল্প এল লুমা’র কানে। স্থান, কাল, পাত্রই যা আলাদা, দশা সব এক। কথায় কথায় বেরিয়ে এল যত সব অস্বাভাবিকতা, কালো দাগ, হাড়মাংস। লুমা স্তব্ধ হওয়ারও সময় পেলেন না। এই পরিমাণ ট্রমা নিয়ে কেউ কী করে হেঁটে চলতে পারে? কারও সঙ্গে কারও কোনও সুতোর যোগাযোগও নেই, প্রত্যেকে বিচ্ছিন্ন কিন্তু গাদাগাদি করে এক জায়গায়, ফালা ফালা হতে আর কত ক্ষণ? যদি না একটা সাধারণ ভাষা আনা যায় ওদের মধ্যে...একটা সাধারণ ভাষা।
|
দ্য ফিউজি’স: বাস্তব |
লুমা প্রথমে বুঝতে পারেননি, সেই ভাষা তিনি কবেই ওই পার্কিং লট-এ ছুড়ে দিয়েছিলেন। সেই ফুটবল। তিলে তিলে বুঝিয়েছিলেন সব্বাইকে, শুধু এক সঙ্গে জড়ো হওয়াকে দল বলে না, জটলা বলে। দল মানে একটা শৃঙ্খলা, একটা নকশা, একটাই ইচ্ছে। স্থানচ্যুতি থাকবে, অচলাবস্থা থাকবে, গত দিনের ভয়াবহ ক্ষত থাকবে, তবু ওই তিন কাঠি থেকে নজর উঠবে না। তবেই না দল।
অন্যরা এটাকে পাগলের এক এক্সপেরিমেন্ট হিসেবেই দেখেছিল, কিন্তু লুমা নিশানায় সদাই স্থির। প্রথম দিন হল না, পরের দিনও হল না, হল না হল না হল না, তার পর হঠাৎ এক দিন সোমালিয়ার একটি ছেলে ইরাকের আর এক জনের কাছ থেকে পাস পেয়ে, বল বাড়িয়ে দিল বসনিয়ার আর এক জনকে, আর সে দু’জনকে কাটিয়ে বল চিপ করল চিরশত্রু এক সার্বকে, আর সেই সার্ব গোলের সামনে আফগানিস্তানের ছেলেটিকে বল ঠেলে নিজের ভাষায় চেঁচাল -- ফাঁকা গোল, গো ফর ইট...তখনই গড়ে উঠল এক অদ্ভুত ফুটবল দল, দ্য ফিউজি’স। আর তখনই কিন্তু অর্ধেক পৃথিবী অদৃশ্য এক তারে বাঁধা পড়ে গেল। সেই তারটাকে গোল্লা পাকালেই ফুটবলের মতো দেখতে। বাঘা রাজনীতিক কখনও যা পারেননি, শান্তির দূত শত অনুরোধেও যা কখনও করতে সমর্থ হননি, সেই অসাধ্য এক শটে করে ছাড়ল ফুটবল। ইতিহাস হলেন লুমা মুফলে।
|
বিদায় ইতিহাস |
একটা খুব কঠিন সংকটকে একেবারে অন্য ঢঙে বাগে আনলেন লুমা। রিফিউজিদের কাছে গিয়ে বললেন, ইতিহাসকে নাকচ করো, ভুলে যাও। ভাবা যায়! এক উদ্বাস্তুর কাছে সবচেয়ে পীড়াদায়ক, সব চেয়ে ভয়ানক তাঁর ইতিহাস। আর লুমা কিনা সেই শেকড়েই কোপ বসালেন। বাবা-মা’র ক্ষেত্রে এটা পারা হয়তো শক্ত হত, কিন্তু তাঁদের বাচ্চারা তো খুব সহজেই পুরনো কথা ভুলতে পারে। ভুললও। আর তাই তো যাদের ছোট থেকেই চিরশত্রু হিসেবে চিনে এসেছে, শুনেছে যাদের বাবা-কাকা’র হাতেই খুন হয়েছিল নিজের গোটা পরিবার, সেই তাদেরই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাস চালাচালি করল ওরা। প্রত্যেক প্রতিযোগিতার শেষে একটা ফেয়ার প্লে ট্রফি দেওয়া হয়, এর চেয়ে বড় ফেয়ার প্লে ট্রফি’র দাবিদার আর কোথায় পাবেন?
লুমা’র এক্সপেরিমেন্ট বাচ্চাদের নিয়ে শুরু হলেও, শেষ অবধি আঁচ লেগেছিল বড়দের গায়েও। পেটের দায়ে ছুটি করতে পারেননি কাজের জায়গায়, খেলা দেখতে যেতে পারেননি দ্য ফিউজি’স-এর, কিন্তু নিশ্চিন্ত মনে ছেলেকে ছেড়ে তো দিতে পেরেছিলেন, দূরে কোথাও লিগ ম্যাচ খেলতে। তথাকথিত শত্রুর সঙ্গে, একা একা। ভয় পাননি এক বারও, আমার ছেলেটা ফিরবে তো? এক জন রিফিউজি’র মনের এই আঁকড়ে বসা ভয়কে কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারা কি চাট্টিখানি কথা? ফুটবল পেরেছে এই অসাধ্য সাধন, লুমা মুফলে পেরেছেন এই ম্যাজিক।
এই গল্প যেখান থেকে শুরু, সেখানে তত ক্ষণে খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই নর্থ অ্যাটলান্টা বনাম দ্য ফিউজি’স। লাইবেরিয়ার ক্রিশ্চিয়ান, লুমা’র ধমক খেয়ে, চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে বলের অপেক্ষায়। নর্থ অ্যাটলান্টা’র কোচ চেঁচিয়ে পাগল করে দিচ্ছেন প্লেয়ারদের। এটা করো, সেটা করো, হাজারো নির্দেশ। আর উল্টো দিকে লুুমা চুপ। তিন গোলে এগিয়ে গিয়েও চুপ। ক্রিশ্চিয়ান এর মধ্যে দু’বার জালে বল জড়িয়েছে। খেলা শেষে স্কোর দাঁড়াল ৯-২, ফিউজি’স-এর পক্ষে। ক্রিশ্চিয়ান পাঁচ গোল। সব্বাই লাফাচ্ছে, লুমা আর এই ক্রিশ্চিয়ান ছাড়া। লুমা’র তাই স্বভাব, এখনও কতটা পথ বাকি যে, আর ক্রিশ্চিয়ান...ও শেষ লাফিয়েছিল, গত মাসে, যখন ওদের বাড়িতে ভয়াবহ আগুন লাগল, প্রায় সব্বাই পুড়ে গেল, সব চেয়ে ছোট্টটি বেচারি খাটের নীচে লুকিয়ে থেকে শেষ হয়ে গেল। আসলে বুঝবে কী করে, আফ্রিকায় তো শেখানো হয়, ওপর থেকে বোমা পড়লে, খাটের তলা-ই সব চেয়ে নিরাপদ। ক্রিশ্চিয়ানই শুধু লাফিয়ে পালাতে পেরেছিল।
|
যারা জাত পেল না |
ফুটবল যে ভাবে গ্লোবাল হয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন টুকরোকে জোড়া লাগাতে পারে, তেমনই মরীচিকা হয়ে হারিয়েও দিতে পারে কাউকে। যেমন নাইজেরিয়ার ৪০ জন উঠতি ফুটবলার, যাঁরা এই মুহূর্তে আটকে রয়েছেন ইস্তানবুলে। চিত্রসাংবাদিক জেসন অ্যান্ড্রুজ এঁদের নিয়েই করছেন তাঁর প্রোজেক্ট : ফুটবল’স লস্ট বয়েজ। ২০১০-এর মার্চ নাগাদ, কোনও এক মিস্টার ওকপস্ এই চল্লিশ জনের কাছ থেকে হাজার হাজার ডলার নিয়ে, ওঁদের ইস্তানবুল আনেন একটি আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে। তুরস্কের ফুটবল ক্লাবে খেলার নেমন্তন্ন। লোভ, এর পরই তো ইয়োরাপ। কানু, দিদিয়ের দ্রোগবা, জর্জ উইয়া’র মতো নাম, ঐশ্বর্য আর আটকায় কে! জীবন পাল্টে যাওয়ার সেই চেনাপরিচিত লোভ। ওঁরা সর্বস্ব ভাসিয়ে ইস্তানবুল এলেন আর তার পরেই মিস্টার ওকপস্ বেপাত্তা। নেমন্তন্নও, বলাই বাহুল্য, ভুয়ো।
এই দু’বছর ধরে ওঁরা ইস্তানবুলের এক এঁদো গলির ঘুপচিতে গাদাগাদি করে দিন কাটাচ্ছেন। সরকার বা অন্য কেউ মোটেও ভাবিত নয়, অতএব নিজেরাই বাসস্থানের নাম রেখেছেন ‘দি অ্যাফ্রিকান গেটো’। এক রকম পরিচয় আর কী। এখনও মাঝেমধ্যে অসময়ে দরজায় টোকা পড়ে। খুব একটা বিচলিত হন না কেউ, যেই হোক, মারবে বড় জোর, মেরে তো ফেলবে না।
ওঁরা কেউ আর বাড়ি ফিরে যেতে চান না, গেলে যে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে, তামাশা হবে। আবার ইস্তানবুলেও তো এ ভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে বেশি দিন নয়। বিচিত্র অবস্থা সত্যি। অভিবাসী বলতে আমরা যা বুঝি, তা ওঁরা নন, কারণ কেউই তো অতর্কিতে বেড়া টপকে পালিয়ে আসেননি। ওঁরা আইন ভাঙতে কখনওই চাননি, শুধু জীবন বদলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এমনই ভাগ্য যে, ওঁরা ছলে-বলে অভিবাসী বনে গেলেন। আর এখন সেই কালো ছোপ বয়ে বেড়াতে বাধ্য। কত দিন কেউ জানে না।
জেসন অ্যান্ড্রুজ ওঁদের এই ছেঁড়া-খোঁড়া অস্তিত্বের বয়ান ধরে রাখছেন ক্যামেরায়। আর জেসন যখন নানা অ্যাঙ্গল থেকে ওঁদের একের পর এক ছবি তুলে চলেছেন, ঘরের ভেতর একটা ছোট্ট টিভিতে তখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা চলছে। চেলসি বনাম টটেনহ্যাম, চল্লিশ জোড়া চোখ জুলজুল করে তাকিয়ে শুধু ওই ফুটবলটার দিকেই... |
|
|
|
|
|