বাম আমলে গঠিত শীল কমিশনের রিপোর্ট বাতিল করে দিনহাটা-কাণ্ডে নতুন একটি কমিশন গড়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে দাবি জানাল বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় পুলিশের গুলি চালনা এবং সেই ঘটনার তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশনের রিপোর্ট এই দুয়েরই কড়া সমালোচনা করে ফব নেতৃত্ব বল ঠেলে দিয়েছেন মমতার সরকারের কোর্টে। ফব নিজেই যে সরকারের শরিক ছিল, তাদের আমলে গঠিত কমিশনের রিপোর্ট ‘প্রত্যাখ্যান’ করে মমতার সরকারের কাছে ‘সম্পূর্ণ ও নিরপেক্ষ তদন্তে’র দাবি জানানোয় রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। শীল কমিশনের রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বর্তমান রাজ্য সরকার কী পদক্ষেপ করবে, তার উপরেই রাজ্য রাজনীতির সমীকরণ এর পরে নির্ভর করবে।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নারায়ণচন্দ্র শীলের নেতৃত্বে গঠিত এক সদস্যের কমিশনের রিপোর্ট বুধবার পেশ করা হয়েছে বিধানসভায়। তার অব্যবহিত পরেই লিখিত বিবৃতি জারি করে ফব-র রাজ্য নেতৃত্ব ওই রিপোর্ট বাতিল করে নতুন কমিশনের দাবি তুলেছেন। চার বছর আগে কোচবিহারের দিনহাটায় ‘আত্মরক্ষার্থে’ই পুলিশ গুলি চালিয়েছিল বলে জানানো হয়েছে শীল কমিশনের রিপোর্টে। পুলিশের ওই দিনের পদক্ষেপ ‘ন্যায্য’ ছিল বলেও কমিশন তার তদন্তে ‘উদঘাটিত’ করেছে।
দিনহাটায় ২০০৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ওই গুলি চালনা এবং তাতে ফব-র পাঁচ জন কর্মী-সমর্থকের মৃত্যুর পরেই তদানীন্তন রাজ্য প্রশাসন বলেছিল, পুলিশ ‘বাধ্য’ হয়েই গুলি চালিয়েছিল। বুদ্ধবাবুরাই যে হেতু তখন রাজ্য প্রশাসনের কর্ণধার ছিলেন, তাই প্রশাসন তথা সরকারের ওই বক্তব্যের পরে ফব-র সঙ্গে সিপিএমের প্রবল টানাপোড়েন তৈরি হয়। শীল কমিশনের রিপোর্ট শেষ পর্যন্ত পুলিশের গুলি চালনারই ‘যৌক্তিকতা’ খুঁজে পাওয়ায় সেই দিক থেকে ‘স্বস্তি’ পেল সিপিএম। যদিও শরিক ফব-র সঙ্গে সম্পর্কে ‘অস্বস্তি’ থেকেই গেল।
বস্তুত, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইউপিএ প্রার্থী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের সিদ্ধান্ত ঘিরে সিপিআই এবং আরএসপি-র সঙ্গে বাকি দুই বাম দল সিপিএম এবং ফব-র ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে। শীল কমিশনের রিপোর্টকে হাতিয়ার করে সিপিএম এবং ফব-র মধ্যেও ‘বিভাজন’ তৈরি করে দেওয়ার সুযোগ মুখ্যমন্ত্রী মমতা পেয়ে গেলেন বলে তৃণমূলের একাংশের ব্যাখ্যা। শীল কমিশনের রিপোর্ট ‘হারিয়ে’ যাওয়া এবং দিনকয়েক আগে আচমকাই তার ‘হদিশ’ পাওয়ার পিছনে এই ‘রহস্য’ই আছে বলে বামেদেরও একাংশের ধারণা। এর পরে সিপিএম এবং ফব-র মধ্যে ‘অস্বস্তি’ আরও বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী কী পদক্ষেপ করেন, সেই দিকে নজর রাজনৈতিক শিবিরের। বাম আমলে পুলিশি গুলিচালনার বিরুদ্ধে বরাবর সরব থেকেছেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা। দিনহাটাও সেই তালিকাতে পড়ে। সেই ঘটনায় পুলিশের পক্ষে-দাঁড়ানো শীল-রিপোর্ট গ্রহণ না-করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা নতুন কমিশন গড়লে (যা ফব-র দাবি) সিপিএমকে ‘অস্বস্তি’তে পড়তে হতে পারে।
সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য এ দিন শীল কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাননি। শীল কমিশন এবং সিপিএম বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত কমিশন দুই কমিশনের তদন্ত রিপোর্টই সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মতে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’! বিরোধী দলনেতার কথায়, “মোটা বই তো! পড়তে সময় লাগবে। আমাদের ৩৪ বছরে যত কমিশন হয়েছিল, এঁরা এক বছরে তার থেকে বেশি কমিশন করেছেন! এ সব পর্বতের মূষিক প্রসব ছাড়া আর কিছু হয়েছে বলে আমার মনে হয় না!” তাঁর আরও বক্তব্য, “আমরাই তো তদন্ত কমিশন (শীল) করেছিলাম।” তবে সেই কমিশনের রিপোর্ট কেন বাম আমলে বিধানসভায় পেশ হয়নি, সেই বিষয়ে সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রী সূর্যবাবু।
বিধানসভায় শীল কমিশনের রিপোর্ট পেশ হওয়ার পরেই ফব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী জরুরি বৈঠকে বসে। পরে দলের তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই রিপোর্ট সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পুলিশের গুলি চালনা আইনসম্মত ও যথাযথ হয়েছিল, তা প্রমাণ করাই এই রিপোর্টের উদ্দেশ্য’। নতুন করে ‘সম্পূর্ণ ও নিরপেক্ষ’ তদন্ত করার জন্য ফের কমিশন গড়ার দাবি তোলা হয় ওই বিবৃতিতে। বাম সরকারের গঠিত কমিশনের রিপোর্ট ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হলে মমতার সরকারের কাছে ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত কি তাঁরা আশা করতে পারেন?
কোচবিহারের জেলা সম্পাদক ও দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন গুহকে পাশে নিয়ে ফব-র রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ বলেন, “যথাযথ কারণ আছে, কেন এই দাবি করছি। কমিশন নিজেই বলছে অসম্পূর্ণ রিপোর্ট। এটা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার! সরকার জানাক, তাদের মত কী?” রিপোর্টে নাম আছে উদয়নবাবু ও ফব-র বর্তমান সাংসদ নৃপেন রায়ের। উদয়নবাবুর বক্তব্য, “রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজ্য আগে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করুক।” |