দুপুরে কর্মস্থল মুম্বই রওনা হওয়ার কথা ছিল তাঁর। তার আগেই দাদাকে বাঁচাতে গিয়ে বাড়ির সামনে বোমায় মারা গেলেন মঙ্গলকোটের লাল্টু মল্লিক (৪০)। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই এই বোমাবাজি ও খুন বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।
বুধবার সকালে বর্ধমানের মঙ্গলকোটে ঝিলু ২ পঞ্চায়েতের ন’পাড়া গ্রামে ওই সংঘর্ষ হয়। পুলিশের হিসেবেই অন্তত ৪০-৫০টি বোমা পড়েছে। জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “আরও কয়েক জন জখম হয়েছেন। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণেই এই ঘটনা।” সিপিএমের ভাগীরথী-অজয় জোনাল কমিটির সম্পাদক দুর্যোধন সরও একই দাবি করেছেন। সাদ্দাম শেখ নামে এক তৃণমূল সমর্থক গুলিতে জখম হয়েছেন। তাঁকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়েছে। যদিও তৃণমূলের বর্ধমান জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথের দাবি, “এর সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই।” রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতারও হয়নি।
লাল্টু মল্লিক |
ঝিলু ২ পঞ্চায়েতে এক সময়ে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সিপিএমের। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের আগে মঙ্গলকোটের ‘দাপুটে’ সিপিএম নেতা ডাবলু আনসারি গ্রেফতার হওয়ার পরেই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরে সিপিএম পঞ্চায়েত সদস্যদের একাংশ তৃণমূলে যোগ দেন। নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পঞ্চায়েতপ্রধান ও উপপ্রধান ‘পলাতক’। ব্লক প্রশাসন কাজ চালায়। কিন্তু একশো দিনের কাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকল্পের ‘নিয়ন্ত্রণ’ বস্তুত স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের হাতেই রয়েছে। আর সেই কাজকর্ম কে দেখাশোনা করবে, তা নিয়েই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সিপিএম ছেড়ে আসা লোকজনের দৌলতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ঝিলু এলাকায় তৃণমূলের প্রধান দু’টি গোষ্ঠীর একটি মঙ্গলকোট বিধানসভা এলাকার কোর কমিটির সদস্য শেখ আব্দুল বাসেদের (২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থী) অনুগামী। অপর গোষ্ঠীর নেতা ঝিলু ২ অঞ্চলে সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি, স্থানীয় ন’পাড়া গ্রামের বাসিন্দা কাশেম কাজি। গত বছরখানেক ধরে তারা বারবার বিবাদে জড়িয়েছে। এ দিন গণ্ডগোল বাধে একশো দিন প্রকল্পে একটি পুকুর খোঁড়াকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ, সকালে বাসেদের লোকজন কাশেম গোষ্ঠীর সাদ্দাম শেখকে মারধর করে। পরে কাশেমের লোকেরা পাল্টা চড়াও হয়। বোমাবাজি শুরু হয়ে যায়, গুলি চলতে থাকে। |
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লাল্টুর দাদা জিয়ার মল্লিক আগে সিপিএম কর্মী ছিলেন। ডাবলু আনসারি গ্রেফতার হওয়ার পরে তিনি কাশেম কাজির দলে ভেড়েন। দিন পনেরো আগে থেকে বাসেদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। যদিও বাসেদ তাঁকে ‘অনুগামী’ বলে মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “জিয়ার মল্লিক কাজ করে কাশেম কাজির হয়ে। গোরু চুরিকে কেন্দ্র করে ওই দু’জনের গোলমাল হয়েছে। কয়েক মাস আগে জিয়ারের বিরুদ্ধেই আমরা পুলিশের কাছে খুনের চক্রান্তের অভিযোগ করেছিলাম।” কাশেম কাজির বক্তব্য, “একশো দিনের কাজ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই দলের মধ্যে গোলমাল চলছে। বাসেদ শেখরা আমাকেও আক্রমণ করেছিল।”
লাল্টু এ সবের মধ্যে ছিলেন না। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি মুম্বইতে এমব্রয়ডারির কাজ করতেন। দিন ১৫-২০ আগে বাড়ি এসেছিলেন। তাঁর নামে পুলিশের খাতাতেও কোনও অভিযোগ নেই। বাড়ির লোকজন জানান, গোলমাল দেখে দাদাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলেন তিনি। বোমায় ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। জখম হন জিয়ারও। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, জিয়ারের স্ত্রী রুপা বিবির দাবি, “আমরা তৃণমূলের বাসেদ গোষ্ঠীর লোক। অন্য গোষ্ঠীর দুষ্কৃতীরা এসে আমার স্বামীর উপরে চড়াও হয়। ওকে বাঁচাতে গিয়েই দেওরের প্রাণ গেল। বোমা খেয়ে ওর মৃত্যু হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে দুষ্কৃতীরা ওর দেহে লাথিও মারে।” |