পরিত্যক্ত কুয়োয় মিলেছিল এক বধূর মৃতদেহ। পাশে ছিল তাঁর আড়াই বছরের শিশুপুত্র। জীবিত।
বিশাল লহরা নামে সেই শিশুকে সোমবার সন্ধ্যায় তার বাবা সাবিন্দ্রর হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে পুরুলিয়ার ঝালদা থানার পুলিশ এবং জেলা শিশু কল্যাণ সমিতি। একই সঙ্গে বিশালের মা সঙ্গীতা লহরা (২৫) খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ নিহত বধূর ‘প্রেমিক’-এর বাবা, শ্বশুর, শাশুড়ি-সহ চার জনকে গ্রেফতারও করেছে। অন্যতম অভিযুক্ত ‘প্রেমিক’ ও তাঁর স্ত্রী পলাতক। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সি সুধাকর মঙ্গলবার বলেন, “ধৃতেরা জেরার মুখে খুনের কথা কবুল করেছে। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরেই এই খুন। অভিযুক্তদের অধিকাংশকেই ধরা হয়েছে। পলাতকদের খোঁজ চলছে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রতিবেশী ওই ‘প্রেমিক’ সঙ্গেই সম্প্রতি শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন সঙ্গীতা। গত ২০ জুন ঝালদা থানার ডরপা গ্রামের অদূরে পরিত্যক্ত কুয়ো থেকে পুলিশ উদ্ধার করে সঙ্গীতার দেহ। পাশে ছিল বিশাল। ওই মহিলার মাথায় গভীর আঘাতের চিহ্ন ছিল। শিশুটিকে পুলিশ ভর্তি করায় পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে। সেখানে দশ দিন থাকার পরে শিশু কল্যাণ সমিতি তাকে পাঠায় বাঁকুড়ার একটি হোমে। তদন্তে নেমে মা-ছেলের পরিচয় জানতে পারে পুলিশ। |
পুলিশের দাবি, তদন্তে তারা জেনেছে, ‘বিবাহ বহির্ভূত’ সম্পর্কের জেরে সঙ্গীতার বিবাহিত ‘প্রেমিক’ সূরজ কারমালি ও তাঁর পরিবারের কিছু লোক খুন করেছে তাঁকে। মাথায় আঘাত করে বিশালকেও কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল আততায়ীরা। বরাতজোরে সে বেঁচে যায়।
পুলিশ জানিয়েছে, সঙ্গীতার স্বামী সাবিন্দ্র পেশায় গাড়িচালক। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে তিনি থাকেন রাঁচি শহরের ধাবানগর এলাকায়। পাশেই থাকেন রাজমিস্ত্রি সূরজ কারমালি ওরফে সুরেন্দ্র। তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তান রয়েছে। সূরজের সঙ্গে ‘বিবাহ বহির্ভূত’ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সঙ্গীতা। জুন মাসের মাঝামাঝি বিশালকে নিয়ে সূরজের সঙ্গেই বাড়ি ছেড়ে পালান সঙ্গীতা।
পুলিশের দাবি, ওই ঘটনার পরে সূরজের স্ত্রী সুলোচনা তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন বাবা গুহি কারমালির কাছে। মেয়েকে নিয়ে তিনি পরে যান সূরজের বাবা জগন কারমালির কাছে। জগন ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাড়িতে ফিরে আসতে বলেন। কথামতো সঙ্গীতাকে নিয়ে সূরজ ঝালদার চাঁদামসিনা গ্রামে সুলোচনার মামা ছোটুয়া কামারের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। পুলিশের আরও দাবি, সেখানেই সঙ্গীতাকে খুন করে দেহ লোপাট করে দেওয়ার ছক কষা হয়। স্ত্রী সুলোচনার সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতিও সুলোচনার আত্মীয়দের দেয় সূরজ।
পুলিশ জানিয়েছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী সঙ্গীতাকে খুন করে তাঁর দেহ ডরপা গ্রামের কাছে পরিত্যক্ত কুয়োয় ফেলে দেওয়া হয়। খুনের উদ্দেশ্যেই ছোট্ট বিশালকে মারধর করে তাকেও মায়ের সঙ্গে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ওই কুয়োয়। গোপন সূত্রে পুলিশের কাছে খবর আসে, ১৯ জুন সঙ্গীতাকে দেখা গিয়েছে চাঁদামাসিনা গ্রামে। এর পরেই তদন্তকারী অফিসার প্রদীপ কর্মকার ও পুলিশ বাহিনী গিয়ে ছোটুয়াকে গ্রেফতার করে। পুলিশের দাবি, জেরার মুখে ছোটুয়া সব বলে দেন। কয়েক দিন আগে ঝাড়খণ্ড থেকে পুলিশ ধরে সূরজের শ্বশুর অর্থাৎ সুলোচনার বাবা গুহি কারমালি ও মা জিউর কারমালিকে। এর পরে পুলিশ নিহত সঙ্গীতার ছবি দেখায় তাঁর স্বামী সাবিন্দ্রকে। তিনি স্ত্রীকে শনাক্ত করেন। মঙ্গলবার ঝাড়খণ্ড থেকেই ঝালদা থানার পুলিশ ধরে সূরজের বাবা জগন কারমালিকে। ধৃতদের মধ্যে গুহি কারমালিকে সাত দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে পুরুলিয়া আদালত। জিউর ও ছোটুয়ার জেল হাজত হয়েছে। জগনকে আজ, বুধবার আদালতে তোলা হবে। সূরজ ও সুলোচনা অবশ্য পলাতক বলে পুলিশের দাবি।
সোমবার সন্ধ্যায় বিশালকে তার বাবা সাবিন্দ্রের হাতে তুলে দিয়েছে পুলিশ ও শিশু কল্যাণ সমিতি। ওই সমিতির সদস্য শ্রীকান্ত গরাই বলেন, “ওই শিশুটির অভিভাবকদের পরিচয় না পাওয়ায় হোমে রাখা হয়েছিল। পুলিশি হস্তক্ষেপে পরিচয় জানার পরে তার বাবার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি।” ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুশি সাবিন্দ্র লহরা। তাঁর কথায়, “বন্ধু হয়েও সূরজ যে আমার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ওকে খুন করবে, তা কখনও ভাবতে পারিনি। একমাত্র সান্ত্বনা, ছেলেকে জীবিত অবস্থায় ফিরে পেলাম। পুলিশ সূরজদের ধরে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করুক, এটাই চাই।” |