|
|
|
|
প্রবন্ধ... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
|
শেক্সপিয়ার, বিবেকানন্দ
এবং মহাভারত |
|
তিনটি বিষয়, চারটি নাটক। কলকাতার কয়েকটি মঞ্চাভিনয় দেখলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
আমার লেখার টেবিলের ঠিক সামনের দেওয়ালের র্যাকে কয়েকখানা বইয়ের মধ্যে রয়েছে একখণ্ডে শেক্সপিয়ারের সমগ্র রচনাবলি। তার মানে অবশ্য এই নয় যে আমি ওই বইটি মাঝে মাঝে পড়ি। অত শখ আমার নেই। এই সব বই সাজিয়ে রাখলেই ভাল দেখায়, মাঝে মাঝে শুধু ধুলো ঝাড়তে হয়।
কয়েক দিন আগে এক সকালে মনে হল, সেই বইটি নামিয়ে ম্যাকবেথ নাটকটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেব নাকি? কারণ, সে দিন সন্ধেবেলায় স্বপ্নসন্ধানী দলের প্রযোজনায়, কৌশিক সেনের পরিচালনা ও অভিনয়ে ম্যাকবেথ নাটকটি দেখতে যাওয়ার কথা। বইটির দিকে হাত বাড়িয়েও থেমে গেলাম। মনে হল, থাক দরকার নেই।
ম্যাকবেথের গল্প তো সবাই জানে। অনেক কাল আগে আমি মূল নাটকটি পড়েওছি কোনও কারণে, কিন্তু এখন অনেক কিছুই মনে নেই, অনেক চরিত্র ও সংলাপ, এখন বই পড়ার বদলে মঞ্চরূপ দেখলে নতুনের মতনই মনে হবে, সব শিল্প-সাহিত্যেই যে মৃদু সাসপেন্স থাকে, তা-ও উপভোগ করা যাবে।
সেই গিরিশবাবুর আমল থেকেই শেক্সপিয়ার বাংলা রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত। প্রধান প্রধান নাটকগুলির একাধিক অনুবাদ করেছেন অনেক বিশিষ্ট লেখক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক গৃহশিক্ষকের আদেশে ম্যাকবেথ অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। প্রত্যেক দিন কয়েক পাতা করতেই হবে। যে দিন রবীন্দ্রনাথ ফাঁকি দিতে চাইতেন, সে দিন তাঁকে ঘরে আটকে রাখা হত। কয়েক পাতা অন্তত অনুবাদ না-দেখাতে পারলে তাঁকে ছাড়া হত না।
রবীন্দ্রনাথ পুরো নাটকটির অনুবাদ শেষ করতে পেরেছিলেন কি না, সে আমরা জানি না। কারণ, সেটা পাওয়া যায়নি। তবে সেই অনুবাদের কয়েকটি পৃষ্ঠা সেই কিশোর কবি শোনাতে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মশাইকে। বিদ্যাসাগর সে সম্পর্কে কী মতামত দিয়েছিলেন, তার কোনও রেকর্ড নেই। (সেই সময় রবীন্দ্রনাথ অন্য এক শিক্ষকের প্ররোচনায় সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করেছিলেন কালিদাসের নাটক কুমারসম্ভব। ওই বয়সে একই সঙ্গে দুটি ভাষার দুটি ক্লাসিক রচনার অনুবাদে ব্যাপৃত হওয়ার মতো অসাধারণ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোনও ভাষায় আছে কি?) |
ত্রিমাত্রিক। ‘স্বপ্নসন্ধানী’-র ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের নামভূমিকায় কৌশিক সেন। |
|
‘বহুরূপী’-র ‘নানা ফুলের মালা’ নাটকে
দুর্যোধনের ভূমিকায় দেবেশ রায়চৌধুরী। |
‘গণকৃষ্টি’-র ‘বিলে’ নাটকে স্বামী
বিবেকানন্দের ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদার। |
|
সৌভাগ্যবশত আমার সিটটা মৃণাল সেনের ঠিক পাশেই। ওঁর কত বয়স তা বোঝাই যায় না। তিনি এখনও নিয়মতি নতুন নতুন নাটক বা তরুণ পরিচালকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফিল্ম আর রুচিসম্মত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন। স্মৃতিশক্তি এখনও বিস্ময়কর। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় তাঁর কাছে রয়েছে অনেক গল্পের ঝুড়ি। ম্যাকবেথ কে কে অনুবাদ করেছেন, সেই সব আলোচনা করতে করতে মৃণালদা বললেন, তাঁদের যৌবনকালে বঙ্গবাসী কলেজের এক অধ্যাপক (নাম উল্লেখ করছি না আমি) ম্যাকবেথের অনুবাদ করেছিলেন। মূল নাটকের এক জায়গায় ছিল ও হরর, হরর, হরর! (ম্যাকবেথের উক্তি) তার অনুবাদ ছিল ত্রাস, ত্রাস, ত্রাস! এর সমালোচনায় ইংরেজি স্টেটসম্যান পত্রিকা (এক সময় এই পত্রিকাটিকে বাঙালিরা বেশ ভক্তিশ্রদ্ধা করত) লিখেছিল, ট্র্যাশ, ট্র্যাশ, ট্র্যাশ!
এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, কোনও রকম উপলক্ষ নেই, কোনও কিছু উদ্যাপনের দায় নেই, তবু কলকাতার রঙ্গমঞ্চে পুরোপুরি আধিপত্য করতে এসেছেন শেক্সপিয়ার! সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়ে সমৃদ্ধ কিং লিয়র। বিভাস চক্রবর্তীর সুদক্ষ পরিচালনায় আর সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মরণীয় অভিনয় এবং নতুন আঙ্গিকে হ্যামলেট। এই কৌশিক সেনের দলের ম্যাকবেথ। এ ছাড়াও রোমিও জুলিয়েট, মিড সামার নাইটস ড্রিম, অ্যাজ ইউ লাইক ইট-এর মতন আরও কয়েকটি নাটকেরও বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। সত্যিই, হঠাৎ এত শেক্সপিয়ার কেন? ধন্য শেক্সপিয়ার।
কৌশিক সেনের অভিনয় প্রতিভার আমি অনেক দিন থেকেই ভক্ত। কয়েক দশক আগে ‘স্লুথ’ নামে একটি ইংরেজি নাটক খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ইংল্যান্ড-আমেরিকায়। তাতে দু’জন মাত্র অভিনেতা তিনটি চরিত্রে এক রুদ্ধশ্বাস রহস্য-কাহিনি জমিয়ে দিতেন। বাংলায় টিকটিকি নামে তার রূপান্তর মঞ্চস্থ হয়েছিল। তাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতন অভিজ্ঞ ও দক্ষ অভিনেতার সঙ্গে সামনে টক্কর দিয়েছিলেন কৌশিক সেন এক তরুণ। আমি বিদেশে মূল ইংরেজি নাটকটি দেখেছি। আর কলকাতায় টিকটিকি। আমার মতে বাংলা নাটকটির রূপান্তর কোনও অংশেই কৃতিত্বে কম নয়, হয়তো বেশি। এর পর কৌশিকের দলের ‘মুখোমুখি বসিবার’ নামে ব্রাত্য বসুর নাটকটিতে অন্য রকম স্বাদ পেয়েছি। এখন তো কৌশিক থিয়েটার আর সিনেমায় সমান ভাবে সার্থকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।
কৌশিক সেনের মুখশ্রী ও কণ্ঠস্বরে বেশ নরম ও মায়াময় ভাব আছে। সম্ভবত সে জন্যই তাঁকে অন্তর্মুখী চরিত্রেই বেশ মানায়। সেই ইমেজটা বদলাবার জন্যই কি কৌশিক সেন ম্যাকবেথের মতন এক কঠোর রুক্ষ চরিত্রে নেমেছেন? তাতেও তিনি সার্থক হয়েছেন অবশ্যই। তবে দ্বিধাদীর্ণ ম্যাকবেথের দাপাদাপির মধ্যেও মাঝে মাঝে হঠাৎ সেই কোমল, মায়াময় রূপটি উঁকি মেরেছে।
বাংলায় ম্যাকবেথের নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। ইদানীং কালে তিনি নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত। এতেও তাঁর সংলাপগুলি বেশ স্বচ্ছন্দ। মুশকিল হচ্ছে এই যে ম্যাকবেথ নাটকটিই বেশ নাটকীয়। সর্বক্ষণ টান টান হয়ে দেখতে হয়। এক এক দৃশ্যে মঞ্চে অনেক মানুষের উপস্থিতি এবং এ কালের ফিজিক্যাল অ্যাকটিং-এর মান্যতায় দৌড়াদৌড়িও অনেক আছে। এত সব চরিত্রের অভিনয়ে কোথাও কারও পদস্খলন ঘটেনি। উচ্চারণও নিখুঁত। এতে পরিচালকের পরিশ্রম ও সার্থকতারই পরিচয় পাওয়া যায়। লেডি ম্যাকবেথ সমেত অন্যান্য প্রধান চরিত্রগুলিও যথাযথ। স্বপ্নসন্ধানীর পরিবেশনায় এই ম্যাকবেথ সাম্প্রতিক কালের এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাটক হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।
|
অতঃপর বিবেকানন্দ |
রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শত বছরের উদ্যাপন সদ্য শেষ হল। এ বারে তাঁর থেকে দেড় দু’বছরের ছোট স্বামী বিবেকানন্দ এসে পড়লেন। তাঁকে কেন্দ্র করে নানান উৎসবের মধ্যে নাটকের স্থান থাকাও স্বাভাবিক। এর মধ্যেই দুটি নাটক দেখার সৌভাগ্য হল আমার। তার একটি চন্দন সেনের পরিচালনায় ‘যুগনায়ক’, অন্যটি গণকৃষ্টির প্রযোজনায় উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিলে’। এর পরিচালক ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়।
বিবেকানন্দর জীবন নিয়ে নাটক রচনা খুব ঝুঁকিবহুল। সেই মহাপুরুষের অগণিত ভক্তদের শ্যেন দৃষ্টির কথা মনে রাখতেই হয়। কোনও রোমান্সের দৃশ্যের প্রশ্নই ওঠে না। নরেন দত্তর স্বামী বিবেকানন্দ হিসেবে রূপান্তর ছাড়া আর কোনও নাটকীয় ঘটনাই নেই। যত দূর সম্ভব না-ছুঁই পানিতে মাছ ধরতেই হয় এবং তা বক্তৃতাবহুল হতে বাধ্য।
‘যুগনায়ক’-এ কৈশোরের নরেন আর বিশ্ববিখ্যাত বিবেকানন্দর ভূমিকায় আছেন দু’জন অভিনেতা। আর ‘বিলে’ নাটকে আরও বাচ্চা বয়সের নরেন আর স্বামী বিবেকানন্দকে মুখোমুখি আনা হয়েছে বারবার। তাদের কাল্পনিক সংলাপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অনেক ঘটনার। প্রথম দিকে যুগ্ম নাট্যকার মানস দাশগুপ্ত ও চন্দন সেনের এই পরিকল্পনা অভিনব মনে হয়েছে। শেষের দিকে তা খানিকটা কৃত্রিমতায় আক্রান্ত।
দ্বিতীয় নাটকটিতে বিবেকানন্দর ভূমিকায় আছেন দেবশঙ্কর হালদার। এই প্রতিভাবান অভিনেতার যে কোনও নাটক দেখার জন্যই আমি উন্মুখ হয়ে থাকি। কিন্তু এই নাটকে দেবশঙ্কর বিশেষ কোনও সুযোগ পাননি, যেন একমেটে মূর্তি, তাতে রং লাগেনি। যুগনায়ক নাটকে বিবেকানন্দর ধর্মীয় ভূমিকার চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর সমাজ সংস্কারকের পরিচয়। তাতে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন শান্তিলাল। দুটি নাটকই অবশ্য দ্রষ্টব্য।
|
এবং মহাভারত |
এখনকার গ্রুপ থিয়েটারের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো সংস্থা বহুরূপী। ছেলেবেলা থেকেই এই দলের নাটক দেখছি নিয়মিত। এখন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, সবিতাব্রত দত্ত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, কুমার রায় নেই। তবু কয়েক জন নিষ্ঠাবান নাট্যপ্রেমিকের উদ্যোগে দল ভেঙে যায়নি, বরং নতুন নতুন নাটকের প্রযোজনায় এগিয়ে চলেছে। আমারই ভাগ্যদোষে গত কয়েক বছর বহুরূপীর কোনও নাটক আমার দেখা হয়নি। কয়েক দিন আগে হঠাৎ এই দলের নতুন নাটক ‘নানা ফুলের মালা’ দেখার সুযোগ এসে গেল।
নবীন নাট্যকার অলখ মুখোপাধ্যায়ের এই নাটকের পরিচালক দেবেশ রায়চৌধুরী, বিষয়বস্তু মহাভারতের একটি অংশের নতুন ইন্টারপ্রিটেশন। এতে দুর্যোধনকে নিছক ভিলেনই সাজানো হয়নি। নানা রকম ফুলের মালা একটি প্রতীক। সেই মালাটি বার বার কণ্ঠবদল করেছে।
দুর্যোধনের বক্তব্য এই যে, নানান রাজ্য মিলিয়ে এই দেশ। সেই সব রাজ্যের আলাদা আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি, সেই সব নষ্ট না-করে, সামগ্রিক ভাবে দেশ গড়ে ওঠে। তিনি তাই চেয়েছেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির যে রাজসূয় যজ্ঞ করেছিলেন তাতেই বোঝা যায়, পাণ্ডবরা সাম্রাজ্যবাদী।
আমি নিজেকে এক জন ছোটখাটো মহাভারত বিশেষজ্ঞ মনে করি। (অবশ্যই আত্মশ্লাঘা ছাড়া আর কিছুই নয়)। নাটকে বার বার দেশ শব্দটি উচ্চারিত শুনে আমার মনে হয়েছে, মহাভারতের সময়ে কেউ কি দেশ শব্দটি জানত? দেশাত্মবোধ সম্পর্কে কারওর কোনও ধারণা ছিল?
সে যেই হোক, ভিন্ন মত তো হতেই পারে। সামগ্রিক দৃশ্যগুলিতে এবং সু-অভিনয়ে নাটকটি বেশ উপভোগ্য। বহুরূপী তাদের পূর্ব সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছে। |
|
|
|
|
|