রাজ্যের আর্থিক দুর্দশা ঘুচাইতে কেন্দ্রের সহযোগিতা চাহিয়া সব দলের সহিত একযোগে দাবি জানাইবার পক্ষপাতী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী এ জন্য সরাসরি বিরোধী পক্ষের বাম বিধায়কদের সহযোগিতা প্রার্থনা করিয়াছেন। বিরোধীরা তাঁহার আহ্বানে সাড়া দিবেন কি না, সেটা তাঁহাদের ব্যাপার। তবে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের তরফে দিল্লির দরবারে রাজ্যের বিধায়ক-সাংসদদের ধর্না দেওয়ার বিষয়টি অভিনব নয়। অতীতে বাম জমানাতেও অনুরূপ সহযোগিতা বিরোধী নেতাদের কাছ হইতে মিলিয়াছে। এই ধরনের সহযোগিতার আহ্বান যে ফিরাইয়া দেওয়া উচিত নয়, বরং রাজ্যের স্বার্থে সব দলেরই ঐক্যবদ্ধভাবে কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানানো উচিত, সে বিষয়ে সম্ভবত কেহই দ্বিমত পোষণ করিবেন না। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বর্তমান বিরোধী পক্ষ বামপন্থীরাও না।
তবে প্রশ্ন উঠিবে, কেবল এই একটি বিষয়ে সর্বদলীয় ঐকমত্যের কথা বলা হইতেছে কেন? শাসন পরিচালনার প্রতিটি গুরুতর ক্ষেত্রে, নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে কেন এই ধরনের সর্বদলীয় সহমত গঠনের কথা শাসকদের স্মরণে থাকে না? তৃণমূল কংগ্রেস যখন বিপুল গরিষ্ঠতা লইয়া রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন হইল, তখন হইতে এত কালের মুখ-দেখাদেখি বন্ধের নাবালক সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়া সহযোগিতার নীতি অনুসৃত হইতে থাকে। বিভিন্ন প্রশ্নে (যেমন রাজ্যের নামকরণ বিষয়ে) বিরোধী পক্ষ সরকার পক্ষের সহিত আলোচনায় বসিতে থাকেন, মুখ্যমন্ত্রীর সহিত বিরোধী নেতার সহাস্য বদনের ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হইতে থাকে। মনে হইতে থাকে, রাজ্য-রাজনীতিতে ‘আমরা-উহারা’র দুস্তর ব্যবধান বুঝি ঘুচিতে চলিয়াছে। কিন্তু অচিরেই সেই বিভ্রম দূর হয়, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুস্থ ঐতিহ্য নয়, প্রতিষ্ঠা পাইতে থাকে তিক্ত পারস্পরিক বিরূপতার চিরাচরিত ইতিবৃত্ত। এমনকী পরস্পরের সহিত বিবাহ-বাসর কিংবা চায়ের দোকানের আড্ডার মতো সামাজিক উপলক্ষেও সাক্ষাৎ, মতবিনিময় ইত্যাদি দলীয় কর্তৃত্বের নিষেধ-জমানার অন্তর্ভুক্ত হয়। এখন মুখ্যমন্ত্রী যে সর্বদলীয় আবেদন-নিবেদনের কথা বলিতেছেন, সেটা নিতান্তই চাপে পড়িয়া, ইহার পিছনে কোনও নীতিগত নমনীয়তা নাই।
ক্ষমতা হাসিল হইবার পর সব শাসকই সচরাচর এ ভাবে চলিতে অভ্যস্ত। নিতান্ত বাধ্য বা কোণঠাসা না হইলে তাঁহারা অন্য দলের সহিত, বিরোধী দলের সহিত শলাপরামর্শ করিতে অনিচ্ছুক। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথাই ধরুন। কংগ্রেস নেতৃত্বের তরফে বিরোধী জোটের সহিত কোনও আলোচনাই করা হইল না। বিরোধীরা ডাক পাইবার অপেক্ষায় রহিলেন, সর্বসম্মত রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে আগাম আলোচনার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু কংগ্রেস হাইকমান্ড সম্পূর্ণ একতরফা ভাবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম আগে স্থির ও ঘোষণা করিয়া অতঃপর বিরোধী জোটের শরিক দলগুলির নেতাদের সমর্থন চাহিলেন। ইহা কোনও সর্বদলীয় মতৈক্যের রাজনীতি নয়, শাসকের একতরফা সিদ্ধান্তকে আলোচিত সর্বসম্মতি রূপে চালাইয়া দিবার কৌশল। কংগ্রেস এই কৌশলে সিদ্ধহস্ত, বরাবর এই কৌশলই অনুসরণ করিয়া আসিয়াছে। বিজেপি তুলনায় অনেক বেশি শরিক দলগুলির কথা শুনিয়া চলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে একতরফা চাপাইয়া দিবার কংগ্রেসি সংস্কৃতিরই উত্তরসূরি, বিরোধীদের উপর সরকারের সিদ্ধান্ত পাশবিক পরিষদীয় গরিষ্ঠতার জোরে চাপাইয়া দিতে চান। রাজ্য-রাজনীতিতে অবশ্য তিনি এ ব্যাপারে তাঁহার বামপন্থী পূর্বসূরিদেরও যথার্থ উত্তরাধিকারী। সর্বদলীয় ঐকমত্যে পৌঁছিবার জন্য বিরোধীদের সহযোগিতা সর্বাধিক জরুরি। কিন্তু বিরোধীদের ঐকমত্যে টানিয়া আনার দায় সরকারেরই। |