তিনতলা পর্যন্ত ঝকঝকে শপিং কমপ্লেক্স। হালফিলের হাজারো পণ্যে আর পাঁচটা শহরের বড় মলের মতোই। কিন্তু চার তলায় পা রাখতেই এক টুকরো কাশ্মীর!
পর্যটকরা দেখতে পান যে ভূস্বর্গ, কিংবা আম-কাশ্মীরির রোজনামচায় মিশে থাকা শান্তি-অশান্তির উপত্যকা নয়, হারিয়ে যাওয়া কাশ্মীর থমকে রয়েছে যেন। এখানে পা রেখে তাই থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে ‘সঙ্গরমল’-এ আসা মানুষজনকেও। ইতিহাসের কাশ্মীরকে কেউ পরম মমতায় সাজিয়ে রেখেছে চারতলার ওই জাদুঘরে। ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক বর্ণময়তায় উজ্জ্বল এই অতীতের দেখা পেতে প্রথম সপ্তাহেই যা ভিড় হচ্ছে, তাতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে বছর পঁয়ষট্টির আতিকা বানুর। তিল তিল করে তিনিই তো মেলে ধরেছেন কাশ্মীরের এই ইতিহাস। এ কাজে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন, এক ঝাঁক তাজা ছেলেপুলেকে। যাঁদের না পেলে আতিকা হয়তো এত দূর এগোতে পারতেন না। কারণ, হারিয়ে যাওয়া কাশ্মীরকে ধরে রাখার কাজে সরকারের কাছ থেকে কোনও সাড়া পাননি এ পর্যন্ত।
সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই প্রদর্শনী মিরাস মহল। |
মিরাস মহলে সাজানো রয়েছে হারিয়ে যাওয়া কাশ্মীর।-নিজস্ব চিত্র |
ছাদের এক কোণের ব্যান্ডে হালফিলের গান। কিন্তু চোখের সামনে প্রাচীন কাশ্মীরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবন থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকের রোজনামচার ইতিবৃত্ত। সেখানেই দেখা মিলবে জামপানের (পাল্কি)। বয়স আড়াইশো বছরেরও বেশি। এই পাল্কি চেপেই নববধূ রওনা দিতেন শ্বশুরবাড়িতে। একটু এগোলে নজরে আসে হজরত বুলবুল শাহের দরগার কিছু ‘পিঞ্জর’ ও ‘মিনারের’ অংশ। তার কাঠের সূক্ষ্ম কাজ বারবার মনে করায় কাশ্মীরের শৈল্পিক ঐতিহ্যের আখ্যান। পাশেই কাঠ ও খড়ের তৈরি নিত্যব্যবহার্য জিনিস ও বাসনকোসন। নান্দনিকতায় যা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। আছে একশো বছরেরও বেশি পুরনো পাণ্ডুলিপি, কাশ্মীরের রাজ-পরিবারের ব্যবহৃত পোশাক। তবে, সর্বত্রই যে সমৃদ্ধির ছবি তা নয়। এক পাশে রাখা আছে একটি চাবুকও। গরিব চাষিদের উপর কাশ্মীরি ভূপতিদের অত্যাচারের ইতিহাস।
ভূস্বর্গের ইতিবৃত্ত জানার এবং জানানোর জেদটা আতিকার অনেক দিনের। এবং শুধুমাত্র এই জেদের উপর নির্ভর করেই ১২টি গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছেন। প্রতিটিই রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায়। বই পড়ার অভ্যাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোপারের বানো-তে আতিকা খুবই পরিচিত একটি নাম। হারিয়ে যাওয়া কাশ্মীরের সন্ধান শুরু করেন ২০০১ সালে। উপত্যকার বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে খুঁজে বার করতে থাকেন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি। আতিকার নিজের সব চেয়ে প্রিয় সংগ্রহটি হল কোরানের একটি হাতে লেখা সংস্করণ। প্রায় ৯০ বছর আগে আতিকারই ঠাকুর্দা, মৌলানা ইয়াসির সোনার কাজ করেছিলেন এতে। মিরাস মহলে রয়েছে বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি। আতিকা জানালেন, কয়েকটির বয়স একশো বছরেরও বেশি। রয়েছে কাশ্মীরি ভাষায় অনূদিত কোরানের দুষ্প্রাপ্য সংস্করণও। এ সব ঘুরে দেখতে দেখতে অন্যদের মতোই মুগ্ধ পঞ্জাবের অমরিন্দার সিংহ বললেন, “কত সমৃদ্ধ কাশ্মীরের ঐতিহ্য! তামা দিয়ে বাসন শুধু নয় তৈরি হত গয়নাও। পাথরের সরঞ্জাম দিয়ে চাষবাস। না দেখলে জানতেই পারতাম না।”
প্রচুর মানুষ আসছেন। আগ্রহের সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন প্রাচীন কাশ্মীরের এই ‘কোলাজ’। ভাল লাগছে আতিকার। প্রবীণা কাশ্মীর-কন্যার গলায় তবু আক্ষেপের সুর, যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়োজিত এই ছোট্ট প্রদর্শনীই এত সফল হতে পারে, তবে সরকারি সাহায্য পেলে কাশ্মীরের ইতিহাসকে খুঁজে দেখার উদ্যোগ আরও কত বড় আকার নিতে পারে! কিন্তু সব জেনেও কার্যত চুপ সরকার। সরকারি জাদুঘরগুলিরও ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ হয় না।
আতিকা বানুর তাই অনুরোধ, উপত্যকার মানুষই এগিয়ে আসুক ইতিহাস খোঁজার ও সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে। ঠিক যে ভাবে তাঁর সঙ্গে ঝাঁক তরুণও খুঁজে বেড়াচ্ছেন, ভূস্বর্গের ইতিহাস।
তাঁদের নিজেদের ইতিহাস। |