বাম আমলের ধার ও সুদের বোঝা নিয়ে কেন্দ্রের কাছে দরবার করতে শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামেদেরই সঙ্গী করতে চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক চাল ‘ফিরিয়ে দিয়ে’ সিপিএম পাল্টা দাবি তুলল, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সর্বদল বৈঠক ডাকুক সরকার। ঘটনাচক্রে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বামেদের মোকাবিলায় আগেই ‘পথে নেমে পড়েছেন’ মুখ্যমন্ত্রী। বামফ্রন্টের বৈঠকের পরে বিমানবাবুরা সর্বদলের দাবি জানানোর আগেই এ দিন সকালে পরিস্থিতি ‘যাচাই’ করতে কলকাতার কয়েকটি বাজারে ঝটিতি-হানা দেন মমতা। শুক্রবার রাতেই তিনি পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছিলেন কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ের সঙ্গে। এ দিন বিকেলে ধর্মতলায় এক অনুষ্ঠানে মমতা ইঙ্গিত দেন, আড়তদারদের সঙ্গে আঁতাঁত করে সিপিএম কৃত্রিম ভাবে আলু ইত্যাদি সব্জির দাম বাড়াচ্ছে।
শুক্রবার মমতা যখন সিপিএম-সহ সব দলের কাছে আর্থিক সঙ্কটে একজোট হতে আবেদন জানান, তাঁর লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। যে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন করেছে সিপিএম, তাঁর ‘অবিচারে’র প্রতিবাদ-কর্মসূচিতে তাদেরও জড়িয়ে নেওয়া। এবং রাজ্যের ঘাড়ে বিপুল ধার ও সুদের বোঝার জন্য যে বাম আমলকে বরাবর দায়ী করে আসছেন তিনি, তা স্থগিত রাখা নিয়ে দরবার করার ক্ষেত্রে বামেদেরও জড়িয়ে নেওয়া।
আর শনিবার বামফ্রন্টের বৈঠক শেষে বিমান বসু যা বলেছেন, তার অর্থও খুব সহজ যে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অপশাসনে’ এই মূল্যবৃদ্ধি, তার ‘প্রতিবাদে’ কেন্দ্রের শরিক তৃণমূল নেত্রী মমতাকে সামিল করা। একই সঙ্গে, সরকার যদি শেষ পর্যন্ত সর্বদল ডাকে, তা হলে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তোলার রাস্তাও খোলা রাখা।
এ দিন বিমানবাবু বলেন, “যে ভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে, তা রুখতে কী কার্যকর পদক্ষেপ করা যায়, তার জন্য সাত দিনের মধ্যে সর্বদল বৈঠক ডাকা হোক।” বৈঠক ডাকার ব্যাপারে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে জুলাই মাস জুড়ে বামফ্রন্ট এক গুচ্ছ কর্মসূচি নিয়েছে। তার মধ্যে রাজ্য জুড়ে আইন অমান্যও রয়েছে। |
কোলে মার্কেটে হঠাৎ হাজির মুখ্যমন্ত্রী। শনিবার সকালে। নিজস্ব চিত্র |
বিমানবাবুর কাছে এ দিন জানতে চাওয়া হয়, কেন্দ্রের কাছে দরবার করতে কি তাঁরা সর্বদলে অংশ নেবেন? বিমানবাবু সরাসরি মন্তব্য না করে বলেছেন, “কেন্দ্রের কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে ওঁরা কী বলেন, আগে সেটা দেখি।” বামফ্রন্ট সূত্রে খবর, স্মারকলিপিতে ফ্রন্ট আমলের আর্থিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে বলা হলে দিল্লি-যাত্রা থেকে বামেরা সরে দাঁড়াতে পারে। রাজ্যের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতির জন্য মমতা বারবার বাম আমলে নেওয়া বিপুল ঋণের কথাই বলছেন। আলিমুদ্দিন তা মানতে নারাজ। যা থেকে স্পষ্ট, বিধানসভার ‘আবেদনে’ মমতা সিপিএমকে ঈষৎ ‘বিপাকে’ ফেলেছেন।
এটা খানিকটা স্পষ্ট হয়েছে বিমানবাবুর কথায়। রাজ্যের স্বার্থে বাম বিধায়করা এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নির্দিষ্ট দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন জানিয়ে বিমানবাবু বলেন, “আর্থিক বিষয়ে কিছু ব্যাপার রাজ্যের হাতে থাকে। কিছু কেন্দ্রের হাতে থাকে। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) কী বলতে চান, তা লিখিত ভাবে দেখতে চাই। উনি সকালে এক কথা বলেন। বিকেলে অন্য কথা!”
আর্থিক সঙ্কটের প্রসঙ্গে কিছুটা ‘বিপাকে’ পড়লেও তাঁরা যে পাল্টা চাল দিতে তৈরি, সেটা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সর্বদল ডাকার কথা বলে বুঝিয়ে দিলেন বিমানবাবু। তিনি বলেন, “নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। আলুর দাম প্রায় ২০ টাকা। অথচ হিমঘরে আলু রয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি কমাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের আওতায় যা যা করা দরকার, রাজ্য সরকারকে তা করতে হবে।”
মমতা অবশ্য ইতিমধ্যেই নিজের মতো করে পরিস্থিতির ‘মোকাবিলায়’ নেমেছেন। শিয়ালদহ বাজার, কোলে মার্কেট ও ল্যান্সডাউন বাজার সরেজমিনে পরিদর্শনের পর তাঁর বক্তব্য, “দু’তিন দিন একটু বৃষ্টি হয়েছে বলেই কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে বাজারের জিনিসের দাম বাড়াচ্ছে। নিজেরা জিনিসপত্র মজুত করে রেখে বলছে, বৃষ্টিতে ফসল-সব্জি নষ্ট হয়ে গিয়েছে! এখানে চাষিদের কোনও দোষ নেই।” সরাসরি সিপিএমের নামোল্লেখ না করে মমতার কটাক্ষ, “কিছু কিছু আড়তদার এখনও তো ওদের (সিপিএমের) সঙ্গে রয়েছে। চাষিরা না-ই বা থাকল ওদের সঙ্গে।”
আদতে ফসলের জোগান যে কম নেই, তা বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রী জানান, চালের উৎপাদন সব থেকে বেশি হয়েছে এ রাজ্যে। চাল বিক্রি করতেও সে জন্য সরকারকে কার্যত হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকার কঠোর ভাবে এই ‘কৃত্রিম’ দামবৃদ্ধির মোকাবিলা করবে জানিয়ে আড়তদারদের মমতার হুঁশিয়ারি, “মানুষের উপর বোঝা বাড়ালে সরকার কঠোর হাতে তা মোকাবিলা করবে। কোনও আড়তদার যদি ঠিক করেন গায়ের জোরে দাম ঠিক করব, সরকার তা করতে দেবে না।”
দিন কয়েক ধরে বাজার-মূল্য বাড়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট দফতর কোনও তথ্য না দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশও করেন। বলেন, “এটা আমার দফতর নয়। মানুষের অভিযোগ পেয়ে নিজে বিষয়টা দেখেছি। কিন্তু যে দফতরের এ ব্যাপারে তথ্য দেওয়ার কথা, তারা দেয়নি। সব কাজ কি আমায় দেখতে হবে?” বাজারদর পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কাল, সোমবার মহাকরণে ব্যবসায়ীদের বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিন মমতা বাজারে বিক্রেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন। বিক্রেতারা মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, তাঁরা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সব্জি ইত্যাদি কেনেন না। কোলে মার্কেট থেকে আনাজ কিনে বিক্রি করেন। বাজারের মধ্যেই কয়েক জন কৃষি-বিক্রেতার দেখা পান মুখ্যমন্ত্রী। যাঁরা সরাসরি গ্রাম থেকে এসে আনাজ বিক্রি করেন এবং একই দাম নেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী জানতে পারেন, গ্রামের হাটে বিক্রি করলে ‘ঠিক দাম’ দেন না মধ্যসত্বভোগীরা। তাই বেশি দাম পাওয়ার আসায় তাঁরা শহরের বাজারে এসেছেন।
গত বারেও কোলে মার্কেট-সহ শহরের কয়েকটি বাজার পরিদর্শন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর বছরভর আনাজের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে এমন কোনও নজির নেই। রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় সব্জির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে যাদের ‘ভিলেন’ বলে মনে করেন, সেই ফড়েদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে কোনও আইন নেই রাজ্যে, তা রাজ্য সরকারের অজানা নয়। সরকারের এক মুখপাত্র জানান, রাজ্যের বহু হিমঘরে বেনামে আলু মজুত করে রেখেছেন আড়তদারেরা।
সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী আলুর দাম বাড়ার কারণ হিসেবে আড়তদারদের দিতে আঙুল তুলেছেন। |