ঘরেও নহে, পারেও নহে
নো ম্যানস ল্যান্ড একটা নিখুঁত ফারাক। কার মধ্যে? কীসের মধ্যে? মাপামাপি করতে যাওয়া নিতান্ত বোকামি। কখনও দেশ, কখনও কাল, কখনও একেবারে অন্তরাত্মার ভেতর সেঁধিয়ে থাকে যে ব্যবধান।
অবস্থান আইডিয়ালি একবারে মাঝখান, একটা ঘেরা অংশ। বেড়া বা কাঁটাতার, সিকিয়োরিটি কিংবা অদৃশ্য গণ্ডির দেখতায় থেকে যায় যুগ এবং যুগ। ঘেরার এ দিক থেকে যত দূরত্ব অতিক্রান্ত, ও দিকেও হয়তো সমান দূরত্ব অতিক্রম্য। ও পারে কী? উত্তর অবান্তর কিংবা অজানা। কারণ ও পারের ঠিক আগে তার তুলকালাম উপস্থিতি, যা অনস্বীকার্য।
আসলে কি কেউ কখনও পেরিয়েছে এই মাঝখান যাহা বিপজ্জনক কিন্তু কাম্য, যার টান অমোঘ তবু পরিত্যাজ্য। যে মাঝখান তৈরি করেছে পরিপাটি ভয়, যে মধ্যম রচেছে হুলস্থুল অসামঞ্জস্য, যে মাঝ বরাবর পড়ে রয়েছে দগদগে অপমান, যে মিড্ল-এর দৌরাত্ম্যে উপড়ে গিয়েছে শিকড়। যে মাঝখানে আনমনে রাখাল ছেলের ভেড়া চলে গিয়েছিল বলে রাখাল হয়ে গেল দাগি স্পাই, যে মাঝখান পেরোতে গিয়ে উগ্রপন্থীর আর দেশের ফেরা হল না, ওই মাধখানে পড়ে রয়েছে দু- দেশের কত মেয়ের সতীচ্ছদ, সঙ্গে এখনও ঝুলছে অপমান, ওই কাঁটাতারের গায়ে গায়ে। যা কোনও গণ্ডি, কোনও সীমা পেরিয়ে শান্ত হয়নি। আর যে মাঝখানের দূরত্ব কখনও সাধারণ মানুষ পেরিয়ে পৌঁছতে পারল না তার লিডারের কাছে। ও দেশ নিষিদ্ধ, তার আগাম বার্তা জারি করবে এই পরিত্যাজ্য এক খণ্ড জমি। ও পার হয়তো ভয়াবহ সাইরেন বাজাবে এই মাঝখান। আর সাধারণ মানুষ যে সাধারণ সে-ও নির্ধারণ করবে অ-সাধারণের সঙ্গে সাধারণের এই দূরত্ব। কাছে চলে এলে ‘অনধিকার চর্চা’র দায় তো বহন করতে হবে সাধারণকেই। ক’দিন আগে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে ভারত-বাংলাদেশ নো ম্যানস ল্যান্ডে এসে পড়েছিল একটি হাতি। বাংলাদেশ থেকে এসেওছিল কিছু লোক সাহায্যের জন্য, কিন্তু ভারত আটকে দিল। ওই নো ম্যানস ল্যান্ড-এর অধিকার ফলাতে। শেষমেষ বাংলাদেশের ওপর দায়িত্ব পড়ল পাঁকে পড়া হাতিটাকে গুলি করে মারার। একটা পরিত্যক্ত জমির কত ক্ষমতা যে সে ক্ষমতার লড়াইকে নিয়ে যায় তুঙ্গে। হাতিটি প্রাণ দিয়ে মূল্য চোকাল নো ম্যানস ল্যান্ড-এর ক্ষমতার।
অর্থাৎ কিনা একটা পরিত্যক্ত মাঝখান আসলে তৈরি করে দিল যাহা কিছু রুল এবং যাহা কিছু নিষিদ্ধ, যা কিছুর দিকে হাত বাড়াতে নেই কিন্তু মনে রাখতে হয় যে ওটা বৃহৎ জুজু। যে সুনিশ্চিত করেছে ঔচিত্য, যে নির্বিঘ্নে রক্ষা করছে ভারসাম্য, যে সংজ্ঞা রচনা করেছে অন্যের সীমাবদ্ধতার।
তবে কি ওইখানটা খালি? কখনওই নয়। বরং ভর্তি ভয় দিয়ে, বেদনা দিয়ে। আমার মনের যে পরিত্যক্ত মাঝখান, তাকে আমি সযত্নে টেকসই বেড়ায় আড়াল করে রেখেছি। কোনও ভাবে যেন কোনও বেয়াড়া হাওয়া, জ্বলজ্বলে রশ্মি, চনমনে কামনা আর না ঢুকতে পারে। আমি তার বাইরে বসিয়ে রেখেছি আমার পোষা সেলফিস জায়ান্টকে। সেই মাঝখান আমি অ-সুরক্ষিত কিছুতেই হতে দেব না। আমার হিংসুটে দৈত্যকে মোটা মাইনে স্থির করেছি এ জন্য। যাতে আমিও না কিছুতেই অনুপ্রবেশকারী হয়ে যাই। আমিও নিজেকে অ্যালাও করব না ওই সংরক্ষিত স্থানে। যা আমার পাঁচের-সাতের, উনিশের-সাতাশের ক্ষত কিংবা বোকামি, ভালবাসা, ঘেন্না, অপমান দিয়ে তৈরি। যা আমি সচেতনে পরিত্যাগ করেছি, তা ফিরে পেতে গেলে চরম শাস্তি, এ নিদান হেঁকে দিয়েছে ওই নো ম্যানস ল্যান্ড।
এমনিতে শুনশান পড়ে থাকে এই মাঝখান। আকৃষ্ট হওয়ার মতো কিচ্ছু নেই ভেতরে তবু প্রায় রোজই সময় পেলে ইতিউতি ঝুঁকি। আমি একে বহন করব বাটখারার মতো। আমার হৃদয় নুয়ে পড়বে সেই ভারে। তবু তাকে কেটে বাদ দেওয়া যাবে না। পরিত্যক্ত মাঝখানের ভার নিয়েই চলবে আমার হৃদয়, যেমন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেলো-ওয়ারিয়র’-এর লাশ বয়ে আনে আহত সৈনিক, নিজেদের সীমান্তের দিকে। এই পরিত্যক্ত মাঝখান অক্ষত ও সংযত রাখবে আমার পরবর্তী জীবন, এই পরিত্যক্ত মাঝখান ভারসাম্য আনবে আমার চিন্তায়, এই পরিত্যক্ত মাঝখান শিখিয়ে দেবে আমার লিমিটেশন।
এই সেই নো ম্যানস ল্যান্ড, যার চরাচর ধু ধু, যার হরিৎক্ষেত্র নেই, যার প্রেম নেই, যার ভবিষ্যৎও নেই, কেবল নিশ্চুপ মরে পড়ে থাকা। কেবল অনাদরে তাপ-বৃষ্টি সহ্য করা, তবু ক্ষমতা অসীম। যার একটাই অভিজ্ঞান পরিত্যক্ত। যার সত্তা বলতে তার উপস্থিতিটুকু। যার ধর্ম বলতে কিচ্ছুটি নেই। তবু যার মর্ম গোধূলির মতো উজ্জ্বল। যার প্রয়োজন সন্ধিক্ষণের মতো জরুরি। যার সমীহ সীমাহীন। তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করা চলবে না, পুরোপুরি পরিত্যাগ করা চলবে না। তবু তাকে বহন করতে হবে নিতান্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে। লালন করতে হবে সবটুকু এফর্ট দিয়ে, রক্ষা করতে হবে সবটুকু শক্তি দিয়ে। সে ডিভিডেন্ড দেবে না। কেবল তার উপস্থিতিটুকু দিয়ে বুঝিয়ে দেবে তুমি কী কী ঠিক আর করবে না। এত প্রয়াস কেন একে রক্ষা করার? কারণ বার বার মানুষই বল, আর মন-ই বল, চলে যেতে চায় এই বেড়াজাল টপকে। আর তাই তাকে শাসন করা এত জরুরি। নিয়ম সে মানবে না। কিছুতেই নাগাড়ে থাকবে না ঘরে কিংবা পারে। ওই মাঝখানটায় যে টান, যে মাঝখানটা পেলে হয়তো আমি স্বস্তি পেতাম, সেটা এই নো ম্যানস ল্যান্ডের আওতাতেই যে পড়ে। সে একমাত্র বোধহয় বুঝেছিল মান্টো’র টোবা টেক সিং।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.