|
|
|
|
যা ধারণ করে রাখে দুই চরমের মধ্যে |
দিদেলাস বলেছিলেন, ‘মাঝামাঝি থেকো।’ তাঁর পুত্র শোনেনি, সূর্যের কাছে যেতে
চেয়েছিল সে। বাঙালির সে বালাই নেই। সর্ববিষয়ে সে নিরাপদ মাঝখানে।
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
ক্রিট দ্বীপের রাজা মিনোস-এর কারাগার থেকে পালানোর জন্য পাখির পালক দিয়ে দু’জোড়া ডানা বানিয়েছিলেন দিদেলাস। এক জোড়া নিজের জন্যে, আর এক জোড়া ছেলে ইকারাস-এর জন্যে। গলানো মোম দিয়ে সেই পাখা সংযোজন করলেন দেহে, তার পর আকাশে উড়লেন দু’জনে। ওড়ার আগে পিতা পুত্রকে বললেন, ‘বেশি নীচে নামবে না, তা হলে সমুদ্রের বারি ও বাষ্পে তোমার ডানা ভারী হয়ে যাবে; বেশি উঁচুতে উঠবে না, তা হলে সূর্যের তাপে মোম গলে যাবে। মাঝামাঝি থাকবে।’ ইকারাস আপন তারুণ্যের উৎসাহে এক সময় প্রবীণ পিতার উপদেশ ভুলে গেল, অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেল সে। একটু বেশি উঁচুতে। মোম গলল, ডানা খুলল।
প্রাচীন উপকথার এই কাহিনি যখনই পড়ি, বেদনার পাশাপাশি মনের মধ্যে একটা অনিবার্য তিরস্কার ফেনিয়ে ওঠে হায় রে নির্বোধ বালক, বাবার কথাটা মনে রাখলি না, সূর্যকে ছুঁতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণটা দিলি? বয়স এবং অভিজ্ঞতার পরম পূজারী যাঁরা অর্থাৎ নিদেনপক্ষে নিরানব্বই দশমিক নয় নয় শতাংশ তাঁরা এই গল্প থেকে অনায়াস উপসংহারে পৌঁছে গিয়ে বলবেন, ওই জন্যেই তো বলেছে ‘নাবালকের বুদ্ধি’! কিন্তু গল্পটা মোটেই অত সহজ নয়।
কেন নয়? বেশ, ধরা যাক, যদি ঘটনাটা উল্টো দিকে ঘটত? ইকারাস, ‘নাবালক’ বলেই, যদি যথেষ্ট উঁচুতে উঠতে ভয় পেত? যদি সে থাকতে চাইত ধরণীর কাছাকাছি? তা হলে তো মহাসমুদ্রের সিক্ত নিশ্বাসে ক্রমে তার ডানা দুটি ভারী হয়ে আসত, এক সময় সে আর আকাশে ভেসে থাকতে পারত না, নিমগ্ন হত অন্তহীন জলরাশিতে। তখন কী বলতাম আমরা? অভিজ্ঞতাবাদীরা? নিশ্চয়ই বলতাম, ‘আহা, নাবালক, সাহস নেই!’ |
 |
দিদেলাসের উপদেশটি শুনতে যতটা সহজ সরল, আসলে ততখানিই গভীর। গ্রিক দার্শনিকরা ‘মাঝামাঝি থাকা’ নিয়ে কম কথা বলেননি। এ বিষয়ে আরিস্ততল রচনা করেছিলেন তাঁর দর্শনচিন্তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধারণাটি। ‘গোল্ডেন মিন’। যা চরম, তা-ই ‘ভাইস’ দুর্নীতি, অধর্ম, দোষ। সেই দুই চরমের মাঝখানে যা থাকে, সেটাই ‘ভার্চু’ সুনীতি, ধর্ম, গুণ। কেমন সেই মধ্যে থাকা? ধরা যাক, সাহস। কখন, কী অর্থে সাহস একটি গুণ হয়ে ওঠে? এক দিকে বেপরোয়া দুঃসাহস, অন্য দিকে ভীরুতা দুই দোষের মাঝখানে থাকে যথার্থ সাহস: আরিস্ততল উবাচ। মহাজ্ঞানী মাস্টারমশাই প্রদত্ত এই মধ্য-শিক্ষার মহিমা বুঝলেন না তরুণ সিকন্দর, দুঃসাহসে সওয়ার হয়ে দিগ্বিজয়ে নিষ্ক্রান্ত হলেন এবং আর ফিরলেন না।
মধ্যপথে চলার পরামর্শ কেবল প্রতীচীর নয়, প্রাচ্যেও মহাজনো যেন গতঃ স মধ্যপন্থাঃ। ভোগের চরমে মগ্ন কপিলাবস্তুর সেই রাজপুত্র সহসা এক দিন সত্যের সন্ধানে গৃহত্যাগী হলেন, কৃচ্ছ্রসাধনের চরমে নিয়ে গেলেন নিজেকে, সত্য মিলল না। তার পর সুজাতার পরমান্ন। বোধিলাভ। যে পাঁচ শিষ্য তাঁর সঙ্গে সর্বত্যাগের সাধনায় যোগ দিয়েছিলেন, তথাগত তাঁদেরই প্রথম ‘মঝ্ঝিম’ পন্থার শিক্ষা দিলেন। এক দিকে অসংযমী ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, অন্য দিকে যন্ত্রণাময় আত্মপীড়ন, কোনওটিই ঠিক পথ নয়, বললেন তথাগত। চলতে হবে মধ্যপথে, ভারসাম্যের পথে, সেই পথেই মুক্ত হবে দৃষ্টি, জাগ্রত হবে জ্ঞান, উপলব্ধি হবে শান্তির। বৌদ্ধ দর্শনের পরবর্তী বিবর্তনে এই মধ্যপথের অনেক ব্যাখ্যা, অনেক বিস্তৃতি, অনেক পরিমার্জন, কিন্তু মূল কথাটা ওই একই: চরমে যেয়ো না। এবং কনফুসিয়াসের তত্ত্বেও তারই প্রতিধ্বনি। ‘মধ্যমতার আদর্শ’ তাঁর বাণীতেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। চরমপন্থাকে তিনিও সযত্নে পরিহার করার উপদেশ দিয়েছিলেন। |
 |
আর, কনফুসিয়াসও যখন মধ্যপন্থা বেছে নেন, তখন একটা খটকা লাগে। চিনের সেই প্রাজ্ঞ পুরুষ তো আসলে সামাজিক এবং প্রশাসনিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার সুলুকসন্ধান বলে দিয়েছিলেন, তাঁর দর্শন তো সেই পাটোয়ারি বুদ্ধি ছাড়িয়ে উচ্চতর ভুবনে ওঠেনি। তবে কি মাঝামাঝি থাকার দর্শন আসলে সুবিধাবাদের অন্য নাম? আথেন্স থেকে সারনাথ, সর্বত্রই মানুষকে সে পথে চলার উপদেশ দেওয়া হয়েছে আসলে এই কারণেই যে, তাতে সমাজ যেমনটি আছে, তেমনটি থাকবে, যাঁদের হাতে ক্ষমতার রশি, সেটি তাঁদের হাতছাড়া হবে না? তা হলে মধ্যপন্থা ধর্ম হয় কী করে?
প্রশ্ন বটে, তবে উত্তরও তো জানা। দুই চরমের মধ্যে যা ধরে রাখে আমাদের, সেটাই তো, আক্ষরিক অর্থে, ধর্ম। তার পরেও নিশ্চয়ই চরমের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য, সে চরম সর্বনাশের পথে নিয়ে গেলেও। আরিস্ততল যতই মাঝামাঝি থাকার কথা বলুন, আলেকজান্ডার বিশ্বজয়ে বেরোবেনই তবু, বাজি রাখবেনই সর্বস্ব। কিন্তু মা ভৈঃ, মধ্যপথ ডেকে নেবে তাঁর উত্তরাধিকারীদের, সর্বনাশী প্লাবনের পরে যেমন পলিমাটি এসে ভরে দেয় ধরণীকে।
মানতেই হবে, মধ্যপন্থার মহিমা চমৎকার বুঝেছে বাঙালি। যে কোনও সর্বভারতীয় তালিকা দেখুন, পশ্চিমবঙ্গকে উঁচুতেও পাবেন না, নিচুতেও পাবেন না, সে আছে মাঝামাঝি। আমরা আগমার্কা মধ্যস্থ। চেহারায়, চরিত্রে, লেখাপড়ায়, টাকাপয়সায়, এমনকী দুর্নীতিতেও অন্য অন্য রাজ্যের মন্ত্রীরা কত হাজার কোটি টাকার হেরাফেরিতে ধরা পড়ছেন, আমাদের রাজপুরুষরা গোষ্পদেই নিমগ্ন।
আমরা দিদেলাসের উপদেশ সতত স্মরণ করে চলেছি। সূর্যের কাছাকাছি যাওয়ার বাসনা? শুনলেও পাপ হয়। |
|
|
 |
|
|