|
|
|
|
শৈশব হারিয়ে স্বপ্ন বুনে চলে অজয়, প্রতিমারা |
অনির্বাণ রায় • জলপাইগুড়ি |
বৃষ্টি থাকলেও প্রতিমাকে সকাল সাতটাতেই বাড়ি থেকে বের হতে হয়। তিস্তা বাঁধের পাশে বাড়ি থেকে প্রায় চার কিলোমিটার হেঁটে বাসাবাড়িতে কাজে যেতে হয়। কাজ সেরে ১২ বছরের প্রতিমা সকাল দশটাতে বাড়ি ফেরে। স্নান সেরে স্কুলে পড়তে আসে। স্কুল থেকে ফেরার পরে প্রতিমাকে আর কাজে যেতে না হলেও রত্নাকে কিন্তু বিকেলেও কাজে যেতে হয়। স্কুলে যাওয়ার আগেও বাসাবাড়িতে গিয়ে বাসনমাজা, কাপড় কাচার কাজ করতে হয়। আবার স্কুল থেকে ফিরে বাসাবাড়িতে ঘর ঝাড়পোছার কাজ। এগারো বছরের অজয়ের অবশ্য সকালে কাজ থাকে না। স্কুল থেকে ফিরে তিস্তা বাধের ওপরে একটি সব্জির দোকানে কাজে যায় অজয়। প্রতিমা, রত্না এবং অজয় তিনজনে তিস্তাপাড়ের সুকান্তনগর কলোনির বাসিন্দা। তিনজনই শিশু-শ্রমিক স্কুলে পড়ে। কারও বাবা রিকশা চালান। কারও বাবা পাইপের কাজ করেন। প্রায় সকলের মা পরিচারিকার কাজ করেন। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী রত্না ক্লাসে কোনবার প্রথম বা দ্বিতীয় হয়। প্রতিমা তৃতীয় হয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেছে। অজয় এ বছরই স্কুলে এসেছে। তিনজনকেই পরিবারের আর্থিক অবস্থার বাধ্যবাধকতায় শৈশবেই পরিচারিকা কিংবা দোকানে কাজ করতে হয়। স্বাভাবিক নিয়মেই তিনজনেরই কাজের পরে ক্লান্তি আসে। কিন্তু তিনজনেই স্কুল কামাই করে না। কারণ, শিশুকাল থেকেই বাড়িতে দারিদ্র, অনটন দেখে বড় হতে থাকা অজয় পুলিশ, এবং রত্না আর প্রতিমাকে দিদিমণি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু, দু বেলা কাজ করে রত্না, অজয়রা যে স্কুলে পড়তে আসে, সে স্কুলের পরিস্থিতি কেমন। জলপাইগুড়ি শহরের সেনপাড়া লাগোয়া তিস্তা নদীর পাশে শিশু শ্রমিকদের স্কুল। স্কুল বলতেই যে পরিচিত ছবি চোখে ভেসে ওঠে, প্রতিমাদের স্কুল কিন্তু তেমন নয়। টিনের একটি ছোট দোচালা ঘর। সেই ঘরে এসে মিশেছে নর্দমা. আবর্জনা আর পূঁতিগন্ধময় নর্দমার জল এসে ধাক্কা খায় স্কুলের বারান্দায়। স্কুলের ক্লাসরুমের সর্বত্র দুর্গন্ধ পাক খায়। আগন্তুকদের কটূ গন্ধে মুখে কাপড় গুঁজতে হলেও প্রতিমা, রত্নাদের সে সব বালাই নেই। দুর্গন্ধ তাদের নাক সয়ে গিয়েছে। শিক্ষার আইনে যে কথাই বলা থাকুক না কেন, শিশু শ্রমিকদের স্কুল তৈরির চার বছর হয়ে গেলেও কোনও শৌচাগার নেই। স্কুল চলাকালীন শৌচাগারে যেতে হলে স্কুল লাগোয়া কোনও বাড়িতে যেতে হয়। পানীয় জলের ব্যবস্থাটুকুও স্কুলে নেই। সাকুল্যে পনেরো বাই এগারো ফুটের একটি ছোট ঘরের মেঝেতে ঠাসাঠাসি করে বসে পঞ্চাশ জন ছাত্র ছাত্রী। একই ঘরে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির পড়াশোনা হয়। কোনও পৃথকীকরণ নেই। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীরা সমবেত সুরে নামতা পড়তে শুরু করলে চতুর্থ শ্রেণির বাংলা পড়া বন্ধ হয়ে যায়। আবার চতুর্থ শ্রেণির কোনো ছাত্রকে শিক্ষক বকাঝকা করলে নিচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা পড়া ভুলে সে দিকেই তাকিয়ে থাকে। সাধারণ প্রাথমিক স্কুলগুলিতে পরিকাঠামো তৈরির জন্য অনুদানের ছড়াছড়ি তখন প্রতিমাদের স্কুলে দরমা বেড়ার দেওয়াল ফুটো হয়ে গেলে পলিথিন গুঁজে জোড়াতালি দিতে হয়। এলাকারই এক বাসিন্দার কথায়, “এই স্কুলে তো কিছুই নেই। পাশেই একটা সাধারণ প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। সেখানে জল, শৌচাগার ক্লাসঘর সবই রয়েছে। কিন্তু এই স্কুলটার আর কিছু হয় না।” শিশু শ্রমিকদের মূল স্রোতে ফেরাতে অনেক সরকারি প্রকল্পেই তৈরি হয়েছে। অথচ শিশু শ্রমিক স্কুলের আর্থিক সহায়তাও এক বছর ধরে বকেয়া পড়ে রয়েছে। স্কুলেরই এক শিক্ষক বলেন, “নেহাতই ছেলেমেয়েগুলির পড়াশোনাতে খুব আগ্রহ। তাই কষ্ট সহ্য করেও স্কুলে আসে। ওরা আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো নয়। একরত্তি বয়সেও সকালে-বিকেলে গতর খাটিয়ে কাজ করতে হয়। তার পরেও প্রতিদিন স্কুলে আসে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে নানা সেমিনার হয়। অথচ এখানে ওই স্কুলের হাল ফেরে না।” স্কুলের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি সুব্রত মজুমদার বলেন, “আমরা স্কুলের যাবতীয় সমস্যার কথা প্রশাসনকে জানিয়েছি। হয়তো স্কুলে শৌচাগার তৈরি হবে। এক বছর ধরে স্কুলের অনুদানও বকেয়া পড়ে রয়েছে।” |
|
|
|
|
|