|
|
|
|
নিঃস্ব ভূমি ২ |
বাঁধ যেন আলপথ, ত্রাসের রাত জাগে দ্বীপবাসী |
সুব্রত বসু • কলকাতা |
তিন বছর আগে বয়ে গিয়েছিল প্রলয়ঙ্কর আয়লা-ঝড়। যার ঝাপটায় ভিটেমাটির সঙ্গে ধূলিসাৎ
হয়ে গিয়েছিল
সুন্দরবনের আর্থ-সামাজিক কাঠামোটাই। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে কতটা উঠে দাঁড়াতে পেরেছেন সেখানকার মানুষ?
উত্তর খুঁজেছে আনন্দবাজার। |
সুন্দরবনের ভারতীয় ভূখণ্ডের এক প্রান্তের শেষ জনবসতি কুমিরমারি দ্বীপ। কুমিরমারির সুকরি মুণ্ডা ভয়ে রাতে ভাল ঘুমোতে পারেন না। কৃষ্ণপদ মুণ্ডা বা গোপাল মণ্ডলও তা-ই।
ইদানীং বর্ষার ঢিলেমি, গরমের তেজ দেখেই ওঁদের মনে আতঙ্কের মেঘ জমছে। ওঁদের মন বলছে, প্রকৃতির এ আচরণ আস্বাভাবিক। ঘরপোড়া গরুর মতো আবার একটা বিপর্যয়ের আশঙ্কায় প্রমাদ গুনছেন তাঁরা। “আজন্ম নদীর পাড়ে বাস। আবহাওয়ার ভাবগতিক ভাল ঠেকছে না। মনে হচ্ছে, ফের ঘা খাবে সুন্দরবন” বলেন গোপালবাবু। তিন বছর আগের দগদগে স্মৃতি উগরে দেন সুকরি “আমাদের সাত পুরুষের ভাগ্য, আয়লা এসেছিল দিনের বেলায়। রাতে হলে কুমিরমারির একটা লোকও বাঁচত না!”
ওঁরা জানাচ্ছেন, ২০০৯-এর ২৫ মে’র সেই ভয়াল ঝড়ে দ্বীপের চারধারের ১৭ কিলোমিটার বাঁধের প্রায় সবটাই ধুয়ে-মুছে গিয়েছিল। সরকারি ভাবেও বলা হয়েছে, আয়লায় সুন্দরবনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপের অন্যতম কুমিরমারি। যদিও পরে প্রায় ১৫ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। তা হলে আতঙ্কর কারণ কী?
কুমিরমারির দক্ষিণ প্রান্তে বাগলা নদীর ধারে নদী-বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য গোপালবাবু বললেন, “আয়লার পরে বলা হয়েছিল, বাঁধ আরও উঁচু করতে হবে। আরও শক্তপোক্ত করতে হবে। কিন্তু তা তো হলই না, উল্টে জায়গায় জায়গায় এমন হাল যে, কোটালের সময়ে যখন-তখন বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।”
বস্তুত কুমিরমারির ছবিটা তা-ই বলছে। দ্বীপের দক্ষিণে বাগলা, উত্তরে পুঁইজালি, পুবে রায়মঙ্গল, পশ্চিমে সারসা নদী। বাগলা-রায়মঙ্গলের স্রোতের ধাক্কায় তিন বছর আগে তৈরি বাঁধ কোথাও কোথাও প্রায় ধূলিসাৎ। একই অবস্থা সাতজেলিয়া, গোসাবা-সহ সুন্দরবনের বহু দ্বীপে। দ্বীপবাসীদের জীবনের সুরক্ষা-রেখা যে নদী-বাঁধ, সেগুলো বিপন্ন হয়ে পড়ায় মানুষের রাতের ঘুম চলে গিয়েছে। |
|
বাঁধ ধসে পড়া যেন সময়ের অপেক্ষা। কুমিরমারিতে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
নদী-বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য: সুন্দরবনের দ্বীপগুলো পুরোপুরি গড়ে ওঠার আগেই মানুষ সেখানে বসতি গড়েছে। জোয়ারের সময়ে নদী ফুলে-ফেঁপে উঠলে বহু দ্বীপ জলতলের উচ্চতার নীচে চলে যায়। তখন দ্বীপগুলো যেন কানা-উঁচু গামলা। গামলার কানা হয়ে নদী-বাঁধই রক্ষা করে দ্বীপের ভিতরের অংশকে। তাই নদী-বাঁধ ব্যতীত সুন্দরবনের জনবসতি রক্ষা অসম্ভব।
এবং এই কারণেই সুন্দরবন জুড়ে তৈরি হয়েছে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার নদী-বাঁধ (যার প্রায় আটশো কিলোমিটার ভাঙনপ্রবণ এলাকায়)। এখন প্রশ্ন, জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে দ্বীপ বাঁচাতে বাঁধ কতটা উঁচু করা হবে?
কুমিরমারি-সাতজেলিয়ার মানুষ জানিয়েছেন, আয়লার সময়ে দ্বীপের মাটির প্রায় ১৩ ফুট উপরে উঠেছিল জলতল। সুতরাং এখনকার সাত ফুট উঁচু বাঁধ যে যথেষ্ট নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপরন্তু নদীর স্রোত প্রতিনিয়ত বাঁধে আছড়ে পড়ছে। তাই বাঁধ আরও মজবুত ও চওড়া করা জরুরি। কোনওটাই হয়নি। বরং কুমিরমারি, সাতজেলিয়ায় কিছু জায়গায় বাঁধ ভাঙতে ভাঙতে চাওড়ায় সাকুল্যে দু’ফুটে এসে ঠেকেছে। ঠিক যেন আলপথ!
অথচ আয়লার পরে প্রশাসন ঘোষণা করেছিল, নদী-বাঁধ আরও উঁচু ও চওড়া করতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সেই প্রক্রিয়ার কী দশা, আন্দাজ দিচ্ছে একটা দৃষ্টান্ত। সেচ দফতরের হিসেব মোতাবেক, গোসাবা ব্লকে বাঁধ নির্মাণে ১৬০৩ একর জমি দরকার। অধিগ্রহণ হয়েছে ১৬৯ একরের মতো, অর্থাৎ প্রয়োজনের মাত্র ১০%। এক সেচ-কর্তার কথায়, “পুরো জমি জোগাড় না-হলে কাজে নেমে লাভ কী?”
প্রায় সব ব্লকেই কম-বেশি এই অবস্থা। সুন্দরবনের মানুষ কি বাঁধের জমি দিতে চাইছেন না?
কুমিরমারিতে অবশ্য উল্টো সুর। গোপালবাবুদের দাবি, “মানুষ জমি দিতে তৈরি। প্রশাসনই নিতে আসেনি।” সেচ-কর্তারাও জানিয়েছেন, জমি নেওয়ার কাজ যাদের, সেই ভূমি দফতর বিশেষ এগোতে পারেনি। আর ভূমি-কর্তাদের বক্তব্য, প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণের উপযুক্ত পরিকাঠামো তাঁদের নেই। কিন্তু সুন্দরবনের বাঁধ বাঁচাতে নদীর পাড় বরাবর ‘ম্যানগ্রোভ’ অরণ্য তৈরির যে সুপারিশ বিশেষজ্ঞেরা করেছিলেন, তার কী হল? গোসাবা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি স্বপন চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “বারবার বলা সত্ত্বেও প্রশাসন উদ্যোগী হয়নি।”
রাজ্য সরকার কী বলছে?
সুন্দরবন উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী শ্যামল মণ্ডল বলেন, “অধিগ্রহণের বিষয়টি খুব সংবেদনশীল। তাই সতর্ক ভাবে কাজ করছি। যেখানে জমি পেয়েছি, সেখানে বাঁধ মেরামতি হচ্ছে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কাজও অল্পস্বল্প শুরু হয়েছে।”
অর্থাৎ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যে কাজ করার কথা ছিল, সেখানেও আঠারো মাসে বছর!
অগত্যা ইষ্টনাম জপ করে বিনিদ্র রাত কাটানো ছাড়া সুন্দরবনের উপায় কী? |
(শেষ) |
|
|
|
|
|