|
|
|
|
বিপন্ন শৈশবের সঙ্গে যুদ্ধে পোস্টম্যান |
রূপায়ণ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
জীবনের পাতা ওল্টালে একটা সময় তাঁর সঙ্গে লিওনেল মেসির অসম্ভব মিল।
খুব ছোটবেলায় জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসতে হয় অন্য দেশে। একটা অদ্ভুত রোগ শৈশবে সঙ্গী ছিল তাঁর। মেসির যেমন হরমোন সমস্যা ছিল, তাঁকে তেমনই ভোগাত অন্ত্রে পরের পর অস্ত্রোপচার।
জীবনের পাতা ওল্টালে একটা সময় তাঁর সঙ্গে অ্যাপল স্রষ্টা স্টিভ জোবসেরও অসম্ভব মিল।
নিজের বাবা-মা তাঁকে তুলে দেন অন্যের হাতে। অন্য বাবা-মা তাঁকে বড় করার পরে যখন খুব নাম ডাক হচ্ছে, তখন আসল বাবা-মা তাঁকে ফেরাতে এসেছিলেন। অভিমানী, ক্রুদ্ধ তিনি যাননি।
মেসি বা জোবস নন, ইউরো সেমিফাইনালের মারিও বালোতেলি যেন দশ বছর আগের ব্রাজিলিয়ান রোনাল্ডো হয়ে আবির্ভূত। সে দিন এক কিংবদন্তী জার্মান গোলকিপার অসহায়ের মতো দেখেছিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালে রোনাল্ডোর ভয়ঙ্কর সুন্দর দুই গোল। এ দিন অলিভার কানের উত্তরসূরি কিপার ম্যানুয়েল ন্যুয়েরও বিহ্বল চোখে দেখলেন বালোতেলির ভয়ঙ্কর সৃষ্টি। দ্বিতীয় গোলটার সময় আলগোছে হাততালিও দিলেন। স্বতঃস্ফূর্ত। নতুন প্রজন্মের সেরা কিপার ন্যুয়ের দেখতেই পাননি বালোতেলির গোলা। ‘পি স্কোয়ার’, মানে পেস ও প্যাশন ছিল এত দিন জার্মান ফুটবলারদের সম্পত্তি। বালোতেলি দেখালেন, শুটিং ও হেডিংয়ের ‘পি স্কোয়ার’ আসলে কার দখলে।
অদ্ভুত চুল। আরও অদ্ভুতুড়ে মাঠের ভিতরে হাবভাব। লম্বা চুলের পির্লো এবং বুফোঁর অসাধারণ সৌন্দর্যের দলে কে এই মূর্তিমান বিদ্রোহ?
বালোতেলি এখন
‘সুপার মারিও’ |
সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের এক শহরে জন্মানো বালোতেলির জীবনযাপনের মধ্যে লুকিয়ে ওই বল্গাহীন খামখেয়ালিপনা। বিপন্ন শৈশব তাঁকে তাড়া করে। ইতালি ও ইংল্যান্ডের ট্যাবলয়েডে তাঁকে ঘিরে সত্যি-মিথ্যের গল্প। এক দিন তিনি সতীর্থদের সঙ্গে মারপিট করেন! পর দিনই রাস্তার কোনও গরিবের হাতে তুলে দেন হাজার পাউন্ড। আবার এক দিন তিনি ক্যাসিনোয় ঢুকে ২৫ হাজার পাউন্ড জিতে রাস্তার ধারের ভিখিরিকে দিয়ে দিতে পারেন কয়েক হাজার। ইন্টার মিলানে খেলার সময় দিব্যি রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারেন এ সি মিলানের জার্সিতে। লাল কার্ড, কোচ মোরিনহো বা মানচিনির সঙ্গে ঝামেলা, প্র্যাক্টিসে গণ্ডগোল, ক্লাবের নির্দেশ অমান্য করে জরিমানা, গাড়ি দুর্ঘটনা বালোতেলির জীবনে লেগেই থাকে। এই লোক এক ভাঙা গির্জার ডোনেশন বক্সে ফেলে আসেন কয়েক হাজার পাউন্ড। গোপনে। সেই লোকই আবার ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে দু’বছরে দেখেন পাঁচটি লাল কার্ড, অসংখ্য হলুদ কার্ড!
খামখেয়ালিপনা! জার্মানির বিরুদ্ধে স্বপ্নের গোল করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই একমাত্র ঘটনা নয়। আরও আছে। ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে খেলার সময় ছুটিতে গিয়েছিলেন ইতালিতে। সেখানে এ সি মিলানের নতুন কোচ ঘোষণা হচ্ছে শুনে, সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকে তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে এসেছিলেন। হঠাৎ। কোনও কথা না বলে। এক দিন চলে গিয়েছিলেন মহিলাদের জেল দেখতে। আবার এক দিন এক কিশোর ভক্তের স্কুলে, কে তাকে খেপাচ্ছে দেখতে!
জার্মানির বিরুদ্ধে স্বপ্নের অঘটনের পরে এ হেন বালোতেলি কী করতে পারেন? গ্যালারিতে সোজা গিয়ে তাঁর পালিতা মা সিলভিয়াকে জড়িয়ে ধরেন। আদর করতে পারেন। এবং তার পরে খুব সরল ভাবে বলতে পারেন, “আজকের দু’টো গোল মায়ের জন্য। ফাইনালে বাবা আসবেন। তাঁর জন্য চার গোল করতে হবে।” যা শুনে মনে পড়বে তাঁর অমর সংলাপ। এক বার গাড়ি দুর্ঘটনার পরে পুলিশ তাঁর গাড়িতে পাঁচ হাজার পাউন্ড পেয়েছিল। গাড়িতে এত টাকা কেন? পুলিশের প্রশ্নে বালোতেলির সোজা উত্তর ছিল, “কেন না আমি বড়লোক।”
জীবন কত দ্রুত বদলায়! দু’দিন আগে সহজ গোল নষ্টের পর ইতালির দৈনিকে কার্টুন বেরিয়েছিল তাঁকে ‘কিং কং’ বানিয়ে। ইতালিকে ইউরো ফাইনালে তোলার পরে ‘কিং কং’ এখন ‘কিং’। ব্যাডবয় ফের সুপার মারিও। দশ বছর আগে জার্মান-বধের জোড়া নায়ক রোনাল্ডো-রিভাল্ডো টুইটারে করেছেন মারিও-বন্দনা, ইতালি-বন্দনা। তাঁকে নিয়ে ম্যাঞ্চেস্টারে নতুন গান। মেসিও এখন ঈর্ষা করবেন তাঁকে।
ভাগ্য ভাল থাকলে বার্সেলোনার লা মাসিয়া স্কুলে মেসির সঙ্গেই বেড়ে ওঠার কথা ছিল বালোতেলির। তাঁর পালক মা-বাবাই পাঠিয়েছিলেন বার্সেলোনার ট্রায়ালে। সেখানে নির্বাচিত হয়েও ফিরে আসতে হয় তখনও ইতালির নাগরিকত্ব পাননি বলে। বালোতেলি তখন ইতালিরও নন, ঘানারও নন।
অনেক নামী কোচই স্বীকার করেছেন, প্রতিভার বিচারে বালোতেলি মেসি-রোনাল্ডোর মতো। কিন্তু কোনও দিন কি মেসি হতে পারবেন তিনি? হতেই পারেন, কিন্তু তাঁর বড় সমস্যা মানসিক যন্ত্রণা কাটিয়ে ওঠা। তাঁর চ্যালেঞ্জ, বিপন্ন শৈশবকে জয় করা। মেসির যে চিন্তা নেই। সুপার মারিওকে ঘিরে বারউয়া ও বালোতেলি পরিবারের টানাপোড়েন এখনও ইতালির বড় খবর। বালোতেলি হাহাকার করেন, “আমাকে হাসপাতালে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।” তাঁর আসল বাবা টমাস বারউয়ার মন্তব্য, “ও ভাল থাকবে বলে ওকে দেওয়া হয়েছিল বালোতেলি পরিবারে। উল্টোপাল্টা জিনিস ওর মাথায় ঢোকাচ্ছে বালোতেলিরা।” ছেলে যে বালোতেলি পদবি ব্যবহার করছে, সেটাও তিনি জানেন বহু পরে।
এই সব সমস্যা সত্ত্বেও ইউরো কাপে তিনিই এখন মধ্যমণি। ইউরো কাপ কি এ ভাবে কোনও দিন আফ্রিকান সিংহের গর্জন শুনেছে? শোনেনি, এবং সে কারণেই ঘানাইয়ান বাবা-মায়ের ইতালীয় সন্তান মারিও বারউয়া বালোতেলি হৃদয় ছুঁয়ে ফেলেছেন ফুটবল বিশ্বের।
কবে এক বাঙালি কবি নিজেকে বলেছিলেন, হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান। বালোতেলিও গোলের অরণ্যে নিজেকে পোস্টম্যান ভাবতে ভালবাসেন। দ্বিতীয় গোল করার পরে পাথর খোদাই চেহারায় খালি গায়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বালোতেলি। তিনি এ রকমই। গোলের উৎসব অপছন্দ তাঁর। কেন, জানতে চাইলে বলেন, “পোস্টম্যান যখন চিঠি ডেলিভারি করে, তখন কি ও উৎসব পালন করে? আমি গোল করি, কেন না ওটাই আমার চাকরি।”
ব্রাজিলের রোনাল্ডোর জন্মানোর সময় তাঁর মদ্যপ, হতদরিদ্র বাবাকে পাওয়া যায়নি। তাই জন্মানোর চার দিন পরে তাঁর নাম নথিবদ্ধ হয় হাসপাতালে। দারিদ্র্যের যন্ত্রণা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় গোল সরণিতে। বালোতেলি, ইউরো ফুটবলের নতুন পোস্টম্যানও এক অন্য ডাকবাক্সের খোঁজে। গোলপোস্টের সেই ডাক বাক্সে গোল ‘পোস্ট’ করা যায়! |
|
|
|
|
|