উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্ট শহরে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের আনুষ্ঠানিক সফর এবং আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির (আই আর এ) প্রাক্তন কমান্ডার মার্টিন ম্যাকগিনেস-এর সহিত তাঁহার উষ্ণ করমর্দন ব্রিটেন ও আয়ার্ল্যান্ড উভয় দেশের পক্ষেই এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অতীত ভুলিয়া নূতন করিয়া শুরু করার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার মধ্যেই ঘটনাটির ঐতিহাসিকতা নিহিত। এই আই আর এ-র সহিত ব্রিটিশ প্রশাসনের সংঘাত তিন দশক ধরিয়া সমূহ রক্তপাত, ধ্বংস, বিস্ফোরণ ও অন্তর্ঘাতের তিক্ততা ধারাবাহিক করিয়াছে। পরস্পরের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ, এমনকী ঘৃণাও ফাটিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু সে সব মনে পুষিয়া রাখিয়া বিদ্বেষ ও ঘৃণার চাপান-উতোরের মধ্যে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের দুই জাতিসত্তার সম্পর্ককে অপচয়িত হইতে দেওয়া হয় নাই। নিকটাত্মীয়ের ঘাতকবাহিনীর প্রাক্তন কমান্ডারের দিকে করমর্দনের হাত প্রসারিত করিয়া রানি এলিজাবেথ অতীতের জের টানার পরিবর্তে ভবিষ্যতের দিকে তাকাইতে চাহিয়াছেন।
ইতিহাসে এমন ঘটনা নিতান্ত বিরল নহে। অতীতের অত্যাচার, বৈষম্য ও নির্যাতনের জের টানার পরিবর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা যখন শ্বেতাঙ্গদের সহিত কৃষ্ণাঙ্গদের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও মিলনের প্রয়াস শুরু করেন, তখন দুই পক্ষেই সংশয়বাদীর অভাব হয় নাই। কিন্তু ম্যান্ডেলা বর্ণবৈষম্যের আফ্রিকাকে অতীত করিয়া জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করেন। মায়ানমারে আঙ সান সু চি যখন ফৌজি শাসকদের দ্বারাই আংশিক পুনর্বাসন পাইলেন, পুরানো ক্ষোভ মনে পুষিয়া রাখিলেন না। বিশ্বের নানা দেশে গিয়া তিনি জেনারেল-শাসিত মায়ানমারকেই আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতায় পুষ্ট করার অনুরোধ জানাইতেছেন। আর দেশের মধ্যে তাঁহার এক সময়ের পীড়কদের সহিত জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গড়ার সম্ভাবনা খতাইয়া দেখিতেছেন।
বঙ্গবাসীর কি এই সব সাম্প্রতিক ইতিহাস হইতে কিছু শিখিবার আছে? আছে তো বটেই, কিন্তু বাঙালি রাজনীতিকরা না-শিখিতেই মনস্থ করিয়াছেন। অতীতের জের টানিয়া চলাই আমাদের ধারা। সেই অতীতকে বর্তমানের বৈরিতা অনুশীলনের যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করায় আমরা পারঙ্গম। সংকীর্ণতা অনুশীলন করিতে করিতে আমরা মানুষকে দলপরিচয়ে শনাক্ত করিতে শিখিয়াছি এবং সামাজিক আচরণেও সেই পরিচিতিকে অগ্রাধিকার দিবার অশিক্ষায় মাতিয়াছি। চৌত্রিশ বছর ধরিয়া প্রতিপক্ষ দল বঞ্চনা করিয়াছে বলিয়া আটষট্টি বছর ধরিয়া তাহার প্রতিকার করার অঙ্গীকার করিতেছি। এই ক্ষমাহীনতা, অতীতকে টানিয়া আনিয়া বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করার প্রবণতা একদা প্রতিদ্বন্দ্বীর সহিত করমর্দনের দিকে ঠেলিয়া না দিয়া তাহার ঘরে আগুন দিতে অনুপ্রাণিত করে। আইরিশ প্রজাতন্ত্রীরা ১৯৭২ সালের ‘রক্তাক্ত রবিবার’কে পিছনে ফেলিয়া ব্রিটেনের রানির হাত ধরিতে পারেন। সু চি পারেন জেনারেল থাইন সেইন শাসিত মায়ানমারের জন্য পশ্চিমী গণতন্ত্রের কাছে সাহায্যের ঝুলি লইয়া বাহির হইতে। আর জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকরা ফরমান জারি করেন সি পি আই এম সমর্থকদের সহিত রাস্তাঘাটেও দেখা হইলে মুখ ঘুরাইয়া লও। |