|
|
|
|
ফের জোর সংস্কারে, ‘অর্থমন্ত্রী’ মনমোহনেই আশা দেখছে শিল্পমহল |
ভর্তুকি হ্রাসই ঘুরে দাঁড়ানোর হাতিয়ার |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ভর্তুকি কমানো আর পরিকাঠামো উন্নয়ন মন-মোহিনী রাস্তা ছেড়ে এ ভাবেই নব্বইয়ের মনমোহনী পথে ফিরতে চাইছে ভারতের অর্থনীতি।
মনমোহন সিংহ অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা না-পেরোতেই দেশের দুই শহরে তাঁর দুই প্রধান উপদেষ্টা সি রঙ্গরাজন ও কৌশিক বসু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন, যে কোনও মূল্যে অর্থনীতির হাল ফেরাতে তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং এই লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রথমেই জোর দেওয়া হবে পরিকাঠামো উন্নয়নের উপর। এমনকী ভর্তুকি কমানোর মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হবেন না তাঁরা। ইঙ্গিত স্পষ্ট, ফের সেই সংস্কারের দাওয়াইয়েই ডুবতে বসা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার রাস্তা খুঁজছেন মনমোহন। নব্বইয়ের দশকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস তৈরির সময় ঠিক যেমনটা করেছিলেন তিনি।
এই প্রত্যয় কার্যকরী হবে কিনা, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপরে। বিশেষ করে জোট রাজনীতির বাজারে। বস্তুত, রাজনীতিই যে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা, সে কথা আজ রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিয়েছেন সরকারের দুই আর্থিক উপদেষ্টাই।
তবে শরিকি রাজনীতির কচকচি ছাপিয়ে কেন্দ্রের এই দায়বদ্ধতা ঘোষণায় খুশি শিল্পমহল। অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে ‘অর্থমন্ত্রী’ মনমোহন সিংহের উপর নিজেদের আস্থার কথা এ দিনই স্পষ্ট জানিয়েছে তারা। বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের মতে, মন্দার মেঘে ঘেরা অর্থনীতিকে আশার আলো দেখাতে পারবেন ওই এক জনই। |
|
শুক্রবার ‘টিম-মনমোহনের’ এই তৎপরতায় যেন পুষ্পবৃষ্টি করেছে টাকার দর আর শেয়ার বাজারের উত্থান। ভারতের বাজার সম্পর্কে আস্থার ভিত ফের পোক্ত হতে শুরু করায় সকলকে তাক লাগিয়ে ডলারের সাপেক্ষে ভারতীয় মুদ্রার দর বেড়েছে ১.১৯ টাকা। ৪৩৯ পয়েন্ট লাফিয়ে উঠেছে বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক সেনসেক্সও। মূলত ইউরোপের সমস্যা মেটা নিয়ে আশার আলো এই উত্থানের কারণ হলেও, অন্তত আজকের দিনে তাকে যথেষ্ট প্রতীকী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আগামী দিনে শিল্প ও শেয়ার বাজারের প্রত্যাশাকে আরও কিছুটা উস্কে দিতে পারে আরও দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বয়ান। এ দিনই কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী বীরাপ্পা মইলি বলেন, “অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পর সংসদে সংস্কারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করাই প্রধানমন্ত্রীর প্রথম লক্ষ্য হবে বলে আমার ধারণা।” আর বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা জানান, যে সব রাজ্য বহু ব্র্যান্ডের পণ্যের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ চায়, তাদের আটকানো উচিত নয়।
এমনকী, বাজারের হাল খারাপ থাকায় যে বিলগ্নিকরণ দফতর কিছু দিন আগেও কার্যত ‘হাত গুটিয়ে’ ছিল, অবস্থান বদলে ফেলছে তারাও। কেন্দ্রীয় বিলগ্নিকরণ সচিব মহম্মদ হালিম খান বলেছেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা জোগাড়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে, শুধু বাজারের হাল ফেরার আশায় বসে থাকলে চলবে না। আমার ধারণা, ইতিমধ্যেই সব থেকে খারাপ সময় পিছনে ফেলে এসেছে শেয়ার বাজার।” ফলে অদূর ভবিষ্যতে বেশ কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বাজারে আসতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
|
|
|
অক্টোবর থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু
করবে দেশের অর্থনীতি। পরিস্থিতি
বদলাবে চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই।
কৌশিক বসু
অর্থ মন্ত্রকের প্রধান মুখ্য উপদেষ্টা |
রান্নার গ্যাস, সার
আর ডিজেল
অন্তত
এই তিনটি ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানোর
সুযোগ রয়েছে বলে আমার ধারণা।
সি রঙ্গরাজন
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা |
|
এ দিনই ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা সি রঙ্গরাজন। ওই অনুষ্ঠানের ফাঁকেই তিনি বলেন, “বৃদ্ধির চাকায় গতি ফেরাতে রাজকোষ ঘাটতি কমানো জরুরি। তাই ওই ঘাটতিতে রাশ টানতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।” প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যানের মতে, “রান্নার গ্যাস, ডিজেল এবং সার অন্তত এই তিনটি ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ জন্য কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়তো এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু এ বিষয়ে যে পদক্ষেপ করা হবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।”
নয়াদিল্লিতে আশার কথা শোনান অর্থ মন্ত্রকের প্রধান উপদেষ্টা কৌশিক বসুও। তাঁর দাবি, “আগামী ৪-৫ মাসের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে ভারতের অর্থনীতি। বৃদ্ধির গতি বাড়বে অক্টোবর থেকেই।” সংস্কারের পথে গুটি কয়েক পদক্ষেপই অর্থনীতির ছবি অনেকখানি বদলে দিতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
তবে সংস্কার, বিশেষত ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত ঘোষণা রাজনৈতিক ভাবে যে কতখানি স্পর্শকাতর হতে পারে, সে সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল দুই উপদেষ্টাই। যে কারণে রঙ্গরাজন বলেছেন, “খাদ্যে ভর্তুকিতে হাত দেওয়ার জায়গা নেই। কেরোসিনের দাম বাড়ানোও গরিব মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ, তা আমরা জানি।” একই সঙ্গে তিনি মেনে নিয়েছেন, “ভর্তুকি কমাতে হলে প্রথমেই রাজনৈতিক ঐকমত্যের পথে হাঁটতে হবে আমাদের। রাজনীতিতে মতের মিল হলে তবেই তৈরি হতে পারে ভাল আর্থিক নীতি।”
একই সুরে কৌশিক বসু বলেছেন, “আমরা বার বার বলে এসেছি, স্রেফ গোটা দু’য়েক সংস্কারের বিল পাশই আমূল বদলে দিতে পারে অর্থনীতির চেহারা। কিন্তু তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলির আপত্তি। কাঁটা হয়ে যাচ্ছে শরিকি রাজনীতির টানাপোড়েন।” দেশকে ৮-৯ শতাংশ বৃদ্ধির সড়কে ফেরাতে এই বাধাই সব থেকে আগে উতরোতে হবে বলে মনে করছেন তিনিও।
সাম্প্রতিক অতীতেই একাধিক সংস্কার কর্মসূচিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে অনেকের বক্তব্য, সংস্কারের কড়া দাওয়াই নিয়ে আপত্তি রয়েছে কংগ্রেসের একটা বড় অংশেরও। কারণ, লোকসভা ভোট আর মাত্র দু’বছর দূরে। তার আগে আম-আদমির বিরাগভাজন হতে চান না তাঁরা।
তবে, এ হেন পরিস্থিতিতেও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা নীতিপঙ্গুত্বের অভিযোগ কাটিয়ে অর্থনীতিকে তিনি যে একটা ধাক্কা দিতে চান, সেটা গত দু’দিনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন মনমোহন সিংহ। |
|
|
|
|
|