বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঠফাটা রোদ উপচে পড়ে গরম ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মানুষ, পশু-পাখি সকলেই অতিষ্ঠ। বাবাও অফিস থেকে ঘেমেনেয়ে বাড়ি ফিরছেন। মুখের অভিব্যক্তি বিরক্তি মাখা। মা-ও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পাখার নীচে বসবেন বলে উসখুস করতে থাকেন। এ সবের মধ্যে একমাত্র তুতুলের মন আনন্দ আর খুশিতে উচ্ছল। গরম বেড়ে চলে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে তুতুলের আনন্দ। কারণ, ইস্কুলে গরমের ছুটি পড়ল বলে। আর ছুটি মানেই মামারবাড়ি। এই প্রচণ্ড গরমে সেখানেই তো তুতুলের আনন্দের সাম্রাজ্য বিছানো। অবশেষে দিন গুনতে গুনতে এসে যায় গ্রীষ্মের ছুটি। মাস্টারমশাইয়ের দেওয়া ছুটির কাজগুলো মামার বাড়িতে বসেই শেষ করতে হবে। এই মজার দিনগুলোর জন্য বইখাতা বগলদাবা করতে তুতুলের মন সায় দিচ্ছিল না। মায়ের ধমকানিতে ওগুলো সঙ্গে নিতেই হল। বাবা ট্রেনে চাপিয়ে দিয়ে তুতুলকে সাবধান করলেন মামারবাড়ি গিয়ে একদম দুষ্টুমি করবে না। সব সময় মায়ের কথা শুনবে। বাবার কথা শুনতে শুনতে হুইসিল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। বাবাকে টা-টা, বাই-বাই করে তুতুল চলল মামারবাড়ির স্বপ্নরাজ্যে।
তুতুলের ছোটমামা স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল ওদেরই অপেক্ষায়। স্টেশনে নেমে মামাকে দেখতে পেয়ে একছুট্টে মায়ের হাত ছেড়ে তুতুল মামার হাত ধরল। সবুজে সাজানো বাগানগুলোর বুক চিরে তুতুল মায়ের সঙ্গে মামারবাড়ি পৌঁছল। নাতিকে অনেক দিন পর কাছে পেয়ে দাদু-দিদা সকলেই আহ্লাদে আটখানা। মামাতো ভাই বোনেরাও তুতুলকে পেয়ে খুব খুশি। আর তুতুল নিজে তো খুশিতে একেবারে ডগমগ। |
মামারবাড়ির আদরে আনন্দ আর উচ্ছলতায় তুতুলের দিনগুলো বেশ কাটছিল। শুধু সক্কালবেলা মায়ের ধমকে ইস্কুলের ছুটির কাজগুলো সেরে নেওয়া। তার পর কড়কড়ে রোদ উপেক্ষা করে ভাইবোনেদের সঙ্গে, আবার কখনও একা একাই একের পর এক আমবাগান চষে ফেলা। মাঝে মধ্যে সকলে মিলে খেলতে বসে যাওয়া। এলাডিং বেলাডিং সইলো কীসের খবর হইল...। বিদ্যুৎহীন মামারবাড়িতে তুতুলের ধারে কাছেই আসতে পারে না গরম।
ভাত খাইয়ে সকলের সঙ্গে তুতুলকেও মা ঘুম পাড়িয়ে দেন। কিন্তু সে চোখ মেলেই থাকে। আস্তে আস্তে তালপাতার হাতপাখাটা মায়ের হাত থেকে পড়ে যায়। তুতুল বুঝতে পারে এই বারে মা ঘুমিয়েছে। পা টিপে টিপে তুতুল আমবাগানের দিকে একা একাই বেরিয়ে পড়ে।
প্রখর তাপের ছটা আমগাছগুলোকে এতটুকু কাবু করতে পারেনি। একের পর এক গাছগুলো ছাতার মতো বাগানটাকে ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমবাগানের ঠান্ডা জমিতে পা দিয়ে তুতুলের চোখ চলে যায় হাতের কাছেই হাওয়ায় দুলতে থাকা আমগুলোর দিকে। আম চুরি করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তুতুলের মনে পড়ে যায় বাবার কথা। ট্রেনে ওঠার সময় বাবা বলে দিয়েছেন, তুতুল, ভুলেও তুমি গাছ থেকে আম চুরি করতে যেয়ো না। তা হলেই কিন্তু আমদাদুর খপ্পড়ে পড়বে। আর ধরা পড়লেই একশো ঘা বেতের বাড়ি। কথাটা মনে পড়তেই তুতুলের পিঠটা শিরশির করে ওঠে। সে লোভ সামলে এ গাছ ও গাছ ঘুরে ঝুলে থাকা টুসটুসে ফলগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা বলে। এক দিন বাগানে ঘুরতে ঘুরতে তুতুল দেখতে পায় রোগাপাতলা, গাল তোবড়ানো সাদা চুলের এক জন বুড়ো মানুষকে। গামছা কাঁধে হাতে লাঠি নিয়ে গরমের তাপে ঝিমোচ্ছেন। তুতুল বুঝতে পারে ও-ই আমদাদু। কাছে গিয়ে ডাকতে থাকে আমদাদু, ও আমদাদু।
ঘুমের ঘোরে ধড়ফড় করে বুড়ো তুতুলের দিকে তাকায়। লাঠি উঁচিয়ে বলে, এই কে রে তুই? নিঝুম দুপুরে একা একা এই বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিস!
সে উত্তর দেয়, আমি তুতুল গো। মামারবাড়ি গরমের ছুটিতে বেড়াতে এসেছি। তা তুমি এই গরমে এখানে বসে বসে কী করছ?
আমদাদু উত্তর দেয়, এই বাগানের আম পাহারা দিচ্ছি।
বাবার সাবধানবাণী মনে পড়ে তুতুলের পিঠটা আবারও শিউরে ওঠে। তবু সাহস করে তুতুল বলে, আমদাদু, আমদাদু, ওই যে গাছে টুসটুসে আমটা আমাকে দেখে হাসছে, ওটাকে পেড়ে দেবে? তুতুলের কথা শুনে আমদাদু চোখ কটমট করে বলে ওঠে, তুই জানিস না, এই বাগানে গাছ থেকে আম চুরি করার শাস্তি একশো ঘা বেতের বাড়ি। এখানে গাছ থেকে আম চুরি করা নিষেধ। কেবলমাত্র কালবৈশাখী এলেই ওই আম তুমি পেত পারো। তখন বাগানে এসে আম কুড়িয়ে নিয়ে যেয়ো। এখন বাড়ি যাও। আমদাদুর নিষেধ শুনে শুকনো মুখে তুতুল ঘরে ফেরে আর বিকেল হলেই কালবৈশাখীর আশায় বসে থাকে।
দেখতে দেখতে তুতুলের গরমের ছুটি ফুরিয়ে আসে। হাতে আর মাত্র ক’টা দিন। তুতুল আকাশের দিকে চেয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপ করে
মেঘ জমেছে ঈশান কোণে
উঠবে ধূলির ঝড়
বৃষ্টি মেখে ফলের রাজা
এ বার ঝরে পড়।
এক দিন বিকেলে এমনটাই বলতে বলতে তুতুল গলা বাড়িয়ে আকাশের দিকে চাইল। এক কোণে কালো মেঘের রাশি দেখি মুখটা হাসিতে ভরে উঠল। দূর থেকে শনশন আওয়াজে বাতাস বইতে শুরু করেছে। সঙ্গে মামারবাড়ির টিনের চালে ফটাফট আওয়াজ। তুতুল তাকিয়ে দেখে সাদা সাদা বরফ মাটিতে আছড়ে পড়ছে। ঝড়ের তাণ্ডব আরও একটু বাড়তেই তুতুল আমবাগানে দৌড়ল। তার মনে হল গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে কেউ যেন বেশ কষে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আহ্লাদে আটখানা তুতুল দেখতে লাগল আমের দল গাছের ডাল থেকে একের পর এক মাটিতে আছড়ে পড়ছে। একটা কচুপাতা ছিঁড়ে এক জায়গায় সে আমগুলোকে জড়ো করতে লাগল। এরই মধ্যে বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। তুতুলের খুশিতে আর ধরে না। বৃষ্টিধারায় স্নাত আমগুলিকে আদর করে জড়ো করছে। এ দিক সে দিক গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে। তুতুলের ও-সব দিকে লক্ষই নেই। বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়োতে কুড়োতে সে আমদাদুর কথা ভুলেই গেল।
ক্রমশ ঝড়ের তেজ কমে আসছে। প্রকৃতিও এখন অনেকটা শান্ত। তুতুল দেখল অনেকটা আম সে জড়ো করেছে। ভিজে যাওয়া জামা গা থেকে খুলে ফেলল। সব আমগুলো ওই জামায় বেঁধে তুতুল মামারবাড়ির দিকে চলল। কিছুটা গিয়ে চোখে পড়ল পেল্লাই এক আমগাছের মোটা একটা ডাল ভেঙে পড়েছে। তার পাশেই একটা বুড়ো পড়ে কাতরাচ্ছে। সামনে যেতেই তুতুল দেখল, আরে, এ তো আমদাদু! রক্তে কপালটা ভেসে যাচ্ছে। তুতুল এই দেখে আমদাদুকে ওঠানোর চেষ্টা করল। কোনও রকমে ধরে একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে আমদাদুকে বসাল। তুতুলকে চিনতে পেরে আমদাদু বললেন, তুতুল, বাবা আমার সে দিন তোমাকে একটা আম পেড়ে না দিয়ে কী ভুলটাই না করেছি। এ রকমটা আমি আর কোনও দিন করব না। এই বলে আমদাদু কাঁদতে লাগল। তুতুল আমদাদুর চোখ মুছিয়ে দিল। জামায় বাঁধা আমগুলো খুলে দেখিয়ে বলল, তুমি তো সে দিন মাত্র একটা আম পেড়ে দিতে, আজ আমি কত্তগুলো আমের মালিক দেখেছ! আকাশ-বাতাসের শক্তির কাছে আমরা সব্বাই হেরো, তাই না! কী বলো আমদাদু? আজ তুমিও বাগানের সব আমগুলোকে পাহারা দিয়ে ধরে রাখতে পারলে না। এই বলে তুতুল আমদাদুর কাছে থেকে বিদায় নিল। |