ইউরো ফাইনালে বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা
অর্জুন থেকে রোনাল্ডো যেন কর্ণ
স্পেন-০ (৪)
পর্তুগাল-০ (২)
কটা বিশাল ব্যানার লাগানো রয়েছিল ইউরোয় স্পেনের আস্তানায় ঢোকার মুল গেটের উপরে। তাতে লেখা, “ইতিহাস তোমায় চ্যাম্পিয়ন তৈরি করে দেবে না। চ্যাম্পিয়ন তৈরি করে বিনয়।”
ইতিহাস সত্যিই অতীতের ব্যাপার। কিন্তু টাইব্রেকারে ইউরো ফাইনালে উঠে স্পেন আবার ইতিহাসের সামনে।
লিওনেল মেসির কোপা আমেরিকা যাত্রা শেষ হয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে, টাইব্রেকারে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ইউরো অভিযানের রথের চাকাও বসে গেল টাইব্রেকারে। অর্জুনকে দেখাল কর্ণের মতো। মেসি সে দিন প্রথম পেনাল্টি কিক নিয়েছিলেন টাইব্রেকারে। রোনাল্ডো কেন আগে কিক নিতে গেলেন না? এই প্রশ্নটা তাঁকে তাড়া করবে আজীবন।
স্বপ্নভঙ্গ।
টাইব্রেকার শুরু হওয়ার সময় রোনাল্ডোকে মাঝখানে বসিয়ে, পর্তুগালের বাকিরা গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পেনাল্টি কিকারের তালিকা পড়ে শোনাচ্ছিলেন কোচেরা। টাইব্রেকার শুরুর আগে রোনাল্ডো তাঁর কিপার পাত্রিসিওকে কানে কানে কিছু বলে দিলেন। লা লিগার অভিজ্ঞতা। তা থেকেই জাবি আলন্সোর কিক সেভ পর্তুগিজ কিপারের। তাতেও লাভ হল না। ইনিয়েস্তা, পিকে, রামোস, ফাব্রেগাসরা গোল করলেন। মোতিনহোর কিক সেভ কাসিয়াসের। ব্রুনোর কিক ফিরে এল পোস্টে লেগে। আবার প্রশ্ন, রোনাল্ডো কেন আগে গেলেন না? তাঁর দল তো কর্ণ হওয়ার মতো খেলেনি।
তিকিতাকা না তিকিতাকানেচিও? অসংখ্য পাস খেলেও স্পেন সিটার তৈরি করতে পারছে না দেখে সমালোচকরা এই ‘তিকিতাকা’র অন্য নাম দিয়েছেন। রক্ষণাত্মক কাতানেচিও সিস্টেমের ঢংয়ে তিকিতাকানেচিও। এই দুইয়ের তুমুল বিভ্রান্তিতে স্পেন তাদের পথ থেকে সরে গেল। সরে গেল লেখা ঠিক হবে, না রোনাল্ডোদের তাড়া করা প্রেসিং ফুটবল তাদের সরিয়ে দিল?
হাড্ডাহাড্ডি
রোনাল্ডোকে আটকানোর চেষ্টায় আলবা। শেষ হাসি হাসল অবশ্য স্পেনীয়রাই। ছবি: এপি।
ম্যাচটার চব্বিশ ঘণ্টা আগে থেকে স্প্যানিশরা মাথা ঘামিয়েছিল অন্য একটা কারণে। রিয়াল বেতিসের তেইশ বছরের ফুটবলার মিকি রকের মৃত্যুতে তারা চেয়েছিল এক মিনিট শোক প্রকাশ করতে। কিংবা কালো ব্যাজ পরতে। সেই অনুমতি উয়েফা দিতে চায়নি। ম্যাচ শুরুর ঠিক আগে সেই অনুমতি মেলে। এ সব নিয়ে টানাপোড়েনে মনে হল, স্পেনের বিখ্যাত প্রশান্তিই হারিয়ে গিয়েছে। ক্লান্তি থাবা বসিয়েছে দলটার ফুটবলে।
রোনাল্ডো না ইনিয়েস্তা? ম্যাচটা ছিল এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজারও। দু’জনেই বাঁ দিক থেকে শুরু করেন। প্রথম জনের মূল অস্ত্র গতি এবং শক্তি। দ্বিতীয় জনের টেকনিক এবং নিয়ন্ত্রণ। প্রথম দশ মিনিট খুঁজে পাওয়া যায়নি কাউকেই। রোনাল্ডোর প্রথম সৃষ্টি ১৩ মিনিটে ও রকম একটা সৃষ্টি সুখের উল্লাস মার্কা ক্রস সেন্টারে। নানির মাথা থেকে তুলে নেন কাসিয়াস। ক্রস সেন্টারে পর্তুগিজদের ধারে কাছে কেউ নেই। প্রথম মিনিটে সেন্টারের পাসটা একেবারে ভুল করেছিল স্পেনীয়রা। তার পর থেকে নিজস্ব ‘তিকিতাকা’র তৈলচিত্র তৈরি করতেই পারেননি ইনিয়েস্তা-জাভি-সিলভা। নিজস্ব পথ ভুলে তারা চলে যাচ্ছিল লং পাসের ছায়াপথে।
গ্যালারিতে লাল-হলুদ ঝড়।
বছর তিনেক আগে একটা বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচে তুলকালাম হয়েছিল রোনাল্ডো-ইনিয়েস্তার। ইনিয়েস্তা একটা ফাউলে মাঠে পড়ে যাওয়ার পরেই তাঁকে ‘ডাইভার’ বলেছিলেন রোনাল্ডো। ইনিয়েস্তা বলেন, “আর যাই হোক, ওর কাছে ডাইভিং নিয়ে জ্ঞান শুনব না।” তার পর থেকে দু’জনে দু’জনের সামনে তেতে যান। এ দিনের ম্যাচটায় রোনাল্ডোর একটা ডাইভ দেখা গেল। দেখা গেল, বারের সামান্য উপর দিয়ে চলে যাওয়া দুটো ফ্রি কিক। একটা বিখ্যাত স্টেপ ওভার। কিন্তু গোল এল না। শেষ মিনিটে কাসিয়াসকে ফাঁকায় পেয়েও বল উড়িয়ে দিলেন রোনাল্ডো। ওই গোল কেউ মিস করে? আর বিশ্বকাপ ফাইনালের গোলদাতা ইনিয়েস্তা তার থেকেও সহজ মিস করলেন অতিরিক্ত সময়ে। এই সময়টাই স্পেনকে স্পেনের মতো দেখাচ্ছিল।
ইনিয়েস্তাকে সামলানোর জন্য পর্তুগিজ কোচ বেন্তো রেখেছিলেন মোতিনহোকে। সি আর সেভেনকে সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন পিকেশাকিরার বয় ফ্রেন্ড। বেকেনবাউয়ারের ঢংয়ে বাসের্লোনা ভক্তরা পিকের নাম দিয়েছেন পিকেনবাউয়ার। কিন্তু ইদানীং তাঁর ফোকাস নড়ে গিয়েছে বলে বার্সেলোনা কোচ গুয়ার্দিওলা তাঁকে বসিয়ে স্টপারে খেলাচ্ছিলেন মিডফিল্ডার মাসচেরানোকে। এই ম্যাচ দেখাল গুয়ার্দিওলাই ঠিক। রোনাল্ডো-নানির উইং প্লে সামলাতে হিমসিম খেলেন পিকে। সঙ্গে র্যামোসও। ম্যাচটা যত গড়াচ্ছিল, রোনাল্ডো-নানিকে সামলাতে তত ফাউল করছিল স্পেন ডিফেন্স। এত ফাউল যে স্পেন করে, গত চার বছর বিশ্ব ফুটবল তা জানতে পারেনি। দুটো আক্রমণাত্মক ফুটবল খেললে মাঝেমাঝেই সেটা হয়ে ওঠে ফাউল ও কার্ডের প্রদর্শনী। এই ম্যাচও তার উদাহরণ।
ফরাসিদের তাদের নিজস্ব বাঁশির সুরে নাচতে বাধ্য করিয়েছিল স্পেনীয়রা। অভাবনীয় ও অলৌকিক ভাবে পর্তুগিজরা বাধ্য করল তাদের প্রেসিং ফুটবলের ছন্দে স্পেনীয়দের নিজস্বতা বিসর্জন দিতে। রোনাল্ডোদের স্টাইলটাই আরোপিত হয়ে গেল ইনিয়েস্তা-জাভিদের ফুটবলে। গত চার বছর ধরে পাসিং আর পজেশন মানেই স্পেন। ২০০৮ ইউরোয় তাদের বল পজেশন গড়ে ছিল ৫৬%। ২০১০ বিশ্বকাপে সেটা দাঁড়ায় ৬৫%। এই ইউরোয় সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮%। সেমিফাইনালের বিরতি ও নব্বই মিনিটের শেষে দাঁড়াল ৫৬%। স্পেনের পক্ষে রীতিমতো লজ্জার। কিন্তু আবার গৌরবেরও। নিজেদের অস্বস্তির দিনেও তারা বল পজেশন ভাল রেখে গেল।
অন্য দিন কী হয়, ইনিয়েস্তা ব্যর্থ হলে জেগে ওঠেন জাভি বা দাভিদ সিলভা। জাভিকে বলা হয়, “ভবিষ্যতের কথা ভেবে খেলেন”। বিন্দু বিন্দু জল দিয়ে যেমন সাগর জেগে ওঠে, তেমনই পাস দিয়ে স্পেন গড়ে তোলে জয়ের রাস্তা। পাসিং, পাসিং, গোল, পাসিং, পাসিং, আরও পাসিংএই চেনা পথে চলে খেলাটা। বিপক্ষকে হতভম্ব করে একটা টার্নিং রয়েছে জাভিরস্পেনে বলে ‘পেলোপিনা’। বার্সা বিপদে পড়লে যা ব্যবহার করেন জাভি। এ ম্যাচে সেটাও বেরোল না। সিলভার সঙ্গে জাভিকেও তুলে নিতে হল। মুণ্ডহীন ছকের সমালোচনার জন্য দেল বস্কি এ দিন স্ট্রাইকারে নামিয়েছিলেন সেভিয়ার নেগ্রেদোকে। স্পেনের জনমত তাঁকেই চাইছিল। সেই ফর্মে থাকা ফুটবলার ক’বার বল ধরলেন বোঝা গেল না। এক, দুই, না তিন? তিনই হবে।
ম্যাচ তখনও শুরু হয়নি। গ্যালারিতে সবুজ-মেরুনের উচ্ছ্বাস
অতএব বিরতির মিনিট দশ পরেই স্পেন আবার ৪-২-৩-১ থেকে ফিরল ৪-৬-০। ইউরোর সেরা উপহার মুণ্ডুহীন ছক এবং ‘ফলস নাইন’। নেগ্রেদোর বিদায় এবং ফাব্রেগাসের প্রবেশ। তাতে ছবিটা বদলাল না। কোথায় সিটার, কোথায় সিটার? পর্তুগালের প্রেসিং ফুটবলই চোখে পড়ল বেশি। স্পেনের ফুটবল থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এল, ‘প্ল্যান বি’র একান্ত অভাব। পাস খেলতে খেলতে জয় পেয়ে এদের এমন অভ্যাস হয়েছে যে এরা কর্নারে গোলও ভুলে গিয়েছে। কোথাও হিসেব দেখছিলাম, ১৪৫টা কর্নার করে ২ গোল পেয়েছে স্পেন। এ দিনও তার কোনও উন্নতি হল না।
স্পেনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাগজের প্রথম পাতায় এ দিন দুটো ছবি ছিল পাশাপাশি। একদিকে রোনাল্ডোর ছবি। তার নীচে লেখা, “এ হল পর্তুগালের সেরা তারকা।” অন্য দিকে স্পেনের বিখ্যাত লাল জাসির্র ছবি। তার নীচে লেখা, ‘এটা আমাদের...’ ইঙ্গিত, পর্তুগালের রোনাল্ডোর পাল্টা দেওয়ার জন্য স্পেনের রয়েছে টিমগেম। কোথায় বিশ্বখ্যাত টিম গেম? ইউরো সেমিফাইনালে সেই টিমগেম আর পাসিং ফুটবল খুঁজে গেল বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে যেতে পারেনি রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার কেউ। স্পেন আবার ইউরো ফাইনালে। ইতিহাস সত্যিই তাদের ডাকছে!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.