প্রবন্ধ ২...
অন্যতরদের অধিকার
সমাজ শুনবে না?
স্ত্রী ও পুং। মানবশরীরের এই দোরোখা রূপ, পারস্পরিক পরিপূরকতা ভেঙে যায় যদি কোনও শিশু উভয় যৌনচিহ্ন নিয়ে জন্মায়। হাসপাতালে ডাক্তার বা আঁতুড়ঘরে দাই কোন চিহ্ন বেশি প্রকট ভাবে সংস্থাপিত, সে দেখে যা ভাল বোঝেন, নির্ধারণ করেন। শিশুটি, নিজ অজ্ঞানে, নির্ধারিত হয়, হয় নারী, নয় পুরুষ হিসেবে। কারণ, তা ছাড়া কোনও দ্বন্দ্ব স্ত্রী-পুং লিঙ্গ-দ্বিত্বে স্বীকৃত নয়। এই ইন্টারসেক্সড মানুষগুলিকে আমাদের যৌনরক্ষণশীল পরিবেশে মেয়ে বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। মেয়ের হায়ালজ্জাজনিত ঢাকা-চাপা দেওয়া শরীরে এই যৌনচিহ্নগুলি তা হলে সহসা লোকগোচরে আসতে পারবে না। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে বিভ্রান্তিগুলি প্রকট হয়ে ওঠে, পরে। এই বেমিল-গরমিলের হিসেবে নারী কে/ নারীত্ব কী, পুরুষ কে/ পুরুষত্ব কী এর সীমানা পেরিয়ে পড়ে থাকে এমন যৌনতা, যাকে সমাজ দাবি করে না। দাবি করে না এই নারী-পুং শরীর অতিরেকী যৌনশরীরের কার্যক্রম ও মনস্তত্ত্ব।
‘আমরা দেখব’। এস এস কে এম হাসপাতালের সামনে পিঙ্কির পরীক্ষা
বিষয়ে কৌতূহলী জমায়েত। ২৫ জুন। ছবি: প্রদীপ আদক

মেয়েলি পুরুষ বা পুরুষালি নারী মাত্রেই সমকামী বা রূপান্তরকামী নন। ঠিক যেমন চেনা, ব্যাকরণ-মানা নারীত্ব ও পুরুষত্ব-সম্পন্ন মানুষেরা সমকামী হতেই পারেন। নারীত্ব বা পুরুষত্ব ব্যাকরণ বইয়ে প্রদত্ত ছকের চেয়ে অনেক দুরূহ ও জটিল প্রকরণ। সেই জটিলতার ধার না ধেরে, লিঙ্গ ও যৌনতা বুঝতে না চেয়ে প্রযুক্ত হয় এক ধরনের হিংসার তীব্র রীতি। মেয়েলি পুরুষ বা রূপান্তরকামীর ওপর। শিশুকাল থেকে তার অসম্ভ্রমগুলি খেয়াল করুন। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিজ মর্যাদা ভুলে তাকে ডেকে ফেলবেন সখি বলে, অটোয় সে শুনবে মাসি টাইপের ছেলে, যেতে আসতে তার নিজের প্রতি ঘেন্না তৈরি করা প্রতিটি স্ল্যাং তাকে তাড়া করে বেড়াবে। বাবা-মায়ের অনীহা ও শোধরানোর অক্ষম চেষ্টা, পড়শিদের গঞ্জনা ও বক্রোক্তি, জ্যাঠা-পিসি ও তুতোদের তাচ্ছিল্য ও দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সে নিজেকে ঊন-পুং বা ঊন-মানব ভেবে বড় হবে। বাড়ির বাইরে তার জন্য বরাদ্দ থাকবে বিদ্রুপ-মশকরা, যৌন-হেনস্থা। পুরুষালি মেয়ে তবু কিছু কাজে লাগে। লোকে যখন বলে, ঠিক ছেলের মতো সামলে নিল, তাকে সম্মানই তো দেয়। আমরা তো দেখি পান-বিড়ির দোকানের বাইকদার মেয়েটিকে। ও অজস্র পুরুষালি মেয়েকে, যাঁরা কাঁধে তুলেছেন নিজ ও পরিবারের দায়িত্ব। আর, খেলাধুলোয় তো তাকেই বেশি চাই। শরীরে কম বাঁক থাকলে তবেই তো বেশি ক্ষিপ্র হওয়া সম্ভব। তা-ও খানিক পরে লোকে সংশয় দেখায়, এই ক্ষিপ্রতা কি নারীদক্ষতাবশত, না পুং-হরমোনের জাদু! হরমোন বাইরে থেকে নেওয়া, না তা শরীরেই আছে! শরীরে থাকলে খেলোয়াড়টি কম-মেয়ে কিনা! পিঙ্কির অনির্ণয়যোগ্য নারীত্ব বা পুরুষত্বের পাশে এই প্রশ্নটিও রাখার যে, কোথায় রাখা যাবে সেই সব মানুষকে, যাঁরা স্ত্রী-পুং উভয়ত, অথচ কোনওটি না হয়েও কী ভাবে কোনও একটি বলে চিহ্নিত হয়ে আছেন? খেলাধুলোর ইচ্ছে, প্রায় জৈবিক এই কামনার পূরণেও তাঁদের এই দুই ভাঁজে ভাঁজ হয়ে যেতে হয়, যার সঙ্গে তো যৌনতার কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ সম্পূর্ণ পুরুষ বা নারী না হওয়ায় খেলার মাঠ থেকে মাঝপথে দেখিয়েও দেওয়া হবে লাল কার্ড, অবধারিত অপসারণ। তা হলে খেলবার ইচ্ছে, যা প্রায় বেঁচে থাকার ইচ্ছের সমতুল, তার অধিকার কী করে পাবেন এঁরা!

পিঙ্কি প্রামাণিকের বিষয়টি একটু ভিন্ন। অভিযোগ দু’টি মাত্রায়। পাবলিক পরিসরে অভিযোগ, তিনি লিঙ্গ-পরিচয় ভাঁড়িয়ে খেলেছেন। দ্বিতীয়টি প্রাইভেট। পিঙ্কির গত দু’বছরের সঙ্গিনী তাঁর বিরুদ্ধে যৌন-নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। প্রথমটিতে প্রমাণসাপেক্ষ তিনি কতখানি না-মেয়ে, দ্বিতীয়টিতে তিনি কতটা পুরুষ হলে ধর্ষণ সম্ভব। ধর্ষণ না হলেও যে কোনও যৌন-নিগ্রহই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু চাঞ্চল্য এ জন্য যে গার্হস্থ্য যৌন-হিংসার অভিযোগের ফলে পিঙ্কির নারী হিসেবে দেখানো দক্ষতা ও অর্জিত সম্মান (রাষ্ট্রের ও ব্যক্তিগত) সংশয়ের মুখে পড়ল। এ বার যদি প্রমাণিত হয় পিঙ্কি না-মেয়ে, তাঁর শারীরিক যৌনচিহ্নগুলি বিশেষজ্ঞদেরও বোধ-ক্ষমতার বাইরে, তা হলে তাঁর মেয়ে-খেলোয়াড়ের জাজ্বল্যমান জীবন-নাট্যে এখানেই যবনিকা পতন। বাকি জীবন তিনি কী হতাশায়-অবমাননায়-পাবলিক ঘেন্নায়, কী খুদকুঁড়ো খেয়ে কাটাবেন, তা আমাদের আগ্রহের বিষয় নয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, প্রমাণ হতে হবে শারীরিক পুরুষত্ব। শরীরে পুরুষত্ব প্রমাণ না করা গেলে ধর্ষণের মামলা খারিজ।

পরিস্থিতিটি খেয়াল করুন মানবাধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা তো খানিক রগড়ের পর মেডেল কেড়ে নিয়ে ক্ষ্যান্ত দেব। ক্রোমোসোম-টোম ছেড়ে দিন, পিঙ্কির বয়ান অনুসারে তিনি মেয়ে, আর এটাই যদি তাঁর এতাবৎকালের বিশ্বাস ও বেঁচে থাকা হয়, তা হলে তিনি মেয়ে নন এই অভিযোগে ও পরবর্তী শারীরিক পরীক্ষায় তাঁর কী রকম বিপর্যস্ত লাগতে পারে ভেবে দেখুন। এই যে খাঁচায় পুরে তাঁকে এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘুরিয়ে বেড়ানো হচ্ছে, সার্কাস শেষে পুরে দেওয়া হচ্ছে জেলের কুঠুরিতে, এতে তাঁর মনের কী হাল দাঁড়াচ্ছে? আর যদি পিঙ্কি নিজে জানেন যে তিনি মেয়ে নন, তবে আজীবন যা তিনি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছেন, পেরেওছেন, এমনকী ড্রেসিংরুমের ঘনিষ্ঠ ঘর্মাক্ত নগ্নতায়ও তাঁর গ্লানির অভিজ্ঞান তা প্রকাশিত হওয়ার আগে কল্পনা করতে চেষ্টা করুন তাঁর সমাজচ্যুত সম্মানচ্যুত হওয়ার ভীতি কতখানি। সে দায়িত্ব কি আমরা কেউ নেব?

কোথায় দাঁড়িয়ে পিঙ্কি! ওই ছবিটি তো সকলেই দেখেছেন যাতে তাঁর বুক স্পষ্টত খামচে ধরে এক পুলিশ। পিঙ্কির বাধা দেওয়া হাত টেনে ধরে অন্য জন। তত দূর নারী হিসেবে এখনও প্রমাণিত নয় বলে, নারীর শ্লীলতাহানির মামলা দায়ের করা যাবে না বলে, প্রকাশ্যে মিডিয়ার সাক্ষাতে এই নিগ্রহ সম্ভব? শুধু অব-নারী এই সন্দেহ হয়েছে বলে? এই যে পাবলিক জাতিধর্ম নির্বিশেষে দমদম জেল থেকে বারাসত সরকারি হাসপাতাল বা এসএসকেএম পিঙ্কির পিছু নিয়েছে বেশ একটা খোলা রগড় দেখবে বলে, এর মধ্যে প্রকাশ্যে স্বীকৃত অশ্লীলতা চাখবার একটা মাংসল উদ্দেশ্য আছে। তৃতীয় বা অন্য রকম হলেই কেচ্ছা, তাদের পরিচয় কেবলই যৌন। তার অধিকার নিয়ে যে চাট্টি কথা হতে পারে আমাদের সে বিষয়ে ধারণামাত্র নেই। পুলিশের ডায়েরিতে পিঙ্কি অমুক গ্রামের তমুক প্রামাণিকের ‘ছেলে’। নথিভুক্ত হয়েছে অভিযোগমাফিক। ফলতই চালান হয় পুরুষ সেলে। জেল কর্তৃপক্ষ তুলনায় সংবেদনশীল নিশ্চয়ই। অন্তত একার একটা কুঠুরি, পুং এলাকাতে, বরাদ্দ হয় পিঙ্কির।

যৌনপ্রান্তিক ও রূপান্তরকামী নারীঅধিকার চর্চা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করে পিঙ্কি। জনগণের সঙ্গে তার কথোপকথনের সুযোগ হয় না। এই ‘না’কে কোথায় রাখব আমরা? পিঙ্কির কি আশঙ্কা এই যে এক খোপ থেকে বের করে তাকে পুরে দেওয়া হতে পারে অন্যতর আত্মপরিচয়ের খোপে? কারণ অন্যতর নারী হলে তার খেলার আর সুযোগই থাকবে না। পিঙ্কির প্রসঙ্গে অন্যতর লিঙ্গের মানুষদের অধিকার নিয়ে আলোচনা শুরু হবে কি? ব্যক্তি নিজ জীবনে দখলদারি না চাইলে মানবাধিকার আন্দোলন বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হবে কী প্রক্রিয়ায়, সেও আলোচ্য।

কৃতজ্ঞতা: সুমিতা, স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.