কারেন ক্লাইন স্বনামধন্য কেহ নহেন। নিউ ইয়র্ক-এর সেই ষাটোত্তীর্ণার নাম যে সহসা বিশ্বময় ছড়াইয়া পড়িল, তাহার মূলে একটি নিগ্রহ। পরিভাষায় তিনি ‘বাস-মনিটর’, বাস-এর চলাচলে চালককে সাহায্য করিয়া থাকেন। সম্প্রতি বাসে সপ্তম শ্রেণির কিছু কিশোর কারেন-এর উদ্দেশে বিবিধ গালিবর্ষণ করে, তাঁহাকে উত্ত্যক্ত করে, এমন কিছু কটু কথা বলে যাহা কারেন-এর নিদারুণ মর্মবেদনার কারণ হয়। ঘটনাটি লোকচক্ষুর অগোচরেই থাকিয়া যাইত, বাদ সাধিল একটি জনপ্রিয় ভিডিয়ো-সাইট। তাহাতে ঘটনাটির একটি ভিডিয়ো চিত্র জমা পড়িবার পরেই বিভিন্ন মহল হইতে ছিছিক্কার রব উঠিল, কারেন-এর বেদনা অপনোদনের জন্য অর্থসংগ্রহ শুরু হইল, এখনও পর্যন্ত সেই তহবিলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হইয়াছে। অভিজ্ঞতা বলিবে, বাসচালক তথা সাহায্যকারীদের নানা সময়ে ঈষৎ নিম্নতর শ্রেণির নাগরিক বলিয়া গণ্য করিবার কু-অভ্যাসটি প্রায়শই দেখা যায়। ‘ভদ্র’মহোদয়গণ বাসে চড়িবার কালে অনেক সময় ধরিয়াই লন, বাসের চালক এবং অন্য পরিষেবা প্রদানকারীদের নিজস্ব মর্যাদা আছে। নিছকই টিকিট কাটিবার ফলে তাঁহাদের সেই মর্যাদা হানির কোনও অধিকার যাত্রীদের নাই।
এই অভিজ্ঞতা দুনিয়াভর বিদ্যমান। নিউ ইয়র্ক-এর ঘটনা প্রমাণ করিতেছে, এই অ-সভ্যতাটি তথাকথিত প্রথম দুনিয়ার কেন্দ্রস্থলেও একই ভাবে হাজির। কিন্তু, ঠিক সেই কারণে নহে, এই ঘটনাটি যে গভীরতর অভিনিবেশ দাবি করে, তাহার প্রধান কারণ নিষ্ঠুরতা। এক বৃদ্ধার প্রতি কিশোরদের অকল্পনীয় নিষ্ঠুর মনোভাব। কারেন ক্লাইন পৃথুলা। সেই অবয়ব লইয়া ছাত্রগণ কুৎসিত মন্তব্য করিয়াছে। এমনকী, এমন কথাও বলিয়াছে যে এমন কুৎসিতদর্শন মহিলার সঙ্গে থাকিবে না বলিয়া কারেন-এর পরিবারের লোকজন আত্মহনন করিয়াছে। কোনও ব্যক্তির সহিত, বিশেষত কোনও বয়স্ক ব্যক্তির সহিত যে এমন করিয়া কথা বলিতে নাই, কাহারও মনে এমন ভাবে আঘাত করিতে নাই, তাহা সভ্য সমাজের প্রাথমিক পাঠের অঙ্গ হওয়া উচিত। এই নিষ্ঠুরতাটি অকল্পনীয় ভাবিলে মনের ভিতর কিছু সান্ত্বনা আসে বটে, কিন্তু তাহাতে সংকটের মাত্রা বাড়ে বই কমে না। কারণ, তখন মনে হইতে পারে যে এই ঘটনাটি হয়তো ব্যতিক্রম, আসলে সমূহ প্রক্রিয়াটি এই রূপে চলে না। সেই মিঠা সান্ত্বনায় ভর করিবার কোনও যুক্তি নাই, কারণ কারেন ক্লাইন-এর ঘটনাটি প্রমাণ করিয়া দিয়াছে, যে ভাবে সমাজ চলিতেছে, তাহাতে এই হৃদয়হীনতাই ভবিতব্য।
নিতান্ত সুকুমার বয়স হইতে যে ভাবে হিংসার নানাবিধ প্রকাশ দেখিতে দেখিতে এবং উপভোগ করিতে করিতে শিশুরা বড় হইয়া উঠে, সেই আবহে আর যাহাই থাকুক, সমবেদনা নামক জিনিসটি বিশেষ দৃশ্যমান থাকে না। আত্মসুখই একমাত্র গন্তব্য এবং তাহার জন্য যে কোনও রকম পথই গ্রাহ্য, এই বার্তাই শিশুকাল হইতে মগজে গাঁথিয়া যায়। সেই অবস্থায় কোনও কিশোর বা কিশোরী যদি নিষ্ঠুর আচরণ করেন, তখন ব্যতিক্রম বলিয়া তাহাকে লঘু করিয়া দেওয়া চলে না। বরং, ইহা নির্দেশ করে, সমগ্র প্রক্রিয়াটিরই এক ধরনের শুদ্ধিকরণ জরুরি। অন্যথায়, এই সমস্যা ক্রমে ছড়াইবে। কারেন ক্লাইন একটি বিশেষ দেশের নাগরিক বটে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে কারেন ক্লাইন একটি নির্বিশেষ সত্তা। তাঁহার সংকটটি একটি বিশেষ মানবিক সংকট। সভ্যতার সংকট। সেই সংকটের ভিতরে উন্নত এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে কোনও ভাগাভাগি নাই। অতীতে তেমন ভাগাভাগির অর্থ ছিল, ‘বিশ্বায়ন’ সেই অর্থ লোপাট করিয়া লইয়াছে। এই সামাজিক সঙ্কট দেশজয়ী। |