ক্রীড়াবিদ পিঙ্কি প্রামাণিক পুরুষ না নারী, এই প্রশ্নটি ‘লিঙ্গ’ লইয়া প্রচলিত ধারণাকে আঘাত করিয়াছে। পুরুষ-নারী বিভেদ কী রূপে নিশ্চিত করা যাইবে? যৌন-পরিচয় কি কেবল দেহের দ্বারাই নির্ণয় করা হবে? শ্বেত বা কৃষ্ণ গাত্রবর্ণ যেমন কোনও ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক পরিচয় নির্ণয় করিয়া দেয়, যৌন-পরিচয়ও কি তেমন ভাবে দেহলক্ষণের দ্বারা নির্ণীত হইতে পারে? না কি ধর্মপরিচয়, জাতিপরিচয়ের ন্যায়, যৌন-পরিচয়েরও মূল প্রোথিত আত্মবীক্ষায়? রাষ্ট্রের দ্বারা নিপীড়িত হইবার আশঙ্কায় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা বহু বৎসর নিজেদের ধর্মাচরণ গোপন করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহারা যে খ্রিস্টান সেই প্রত্যয় তাঁহাদের হৃদয়ে সদা জাগরুক ছিল। ব্রিটেনের উপনিবেশ হইয়াও ভারতের মানুষ নিজেদের ‘ভারতীয়’ বলিয়া চিনিয়াছে, ‘ব্রিটিশ’ মনে করে নাই। যৌনতাও ঈশ্বরবিশ্বাস (বা অবিশ্বাস), জাতীয়তাবোধ, সংস্কৃতিচেতনার মতো আত্মপরিচিতির একটি মূল নির্ণায়ক। তবে তাহা কেন কেবল বহিরঙ্গ দ্বারাই নির্ণীত হইবে? যিনি নিজেকে নারী বলিয়াই মনে করেন, তাঁহার মুখমণ্ডলে রোমরাজির আধিক্য থাকিলেই তাঁহার বিশ্বাসকে বাতিল করিয়া দিতে হইবে কেন? যিনি বরাবরই পুরুষের ন্যায় সাজপোশাক, আচার-আচরণ করিয়া আসিয়াছেন তাঁহার পুরুষাঙ্গের অভাবই কি কেবল তাঁহাকে নারী করিয়া দিতে পারে? তাঁহার যৌনচেতনার কি কোনও মূল্যই নাই? বহু পুরুষ-নারী অন্তরের যৌনতার সহিত সমাজ-প্রত্যাশিত লিঙ্গ-নির্ভর যৌন আচরণের মিল করিতে না পারিয়া কষ্টসাধ্য অস্ত্রোপচার করাইয়াছেন, অথবা পরিবার-পরিজন ত্যাগ করিয়া সমাজের মূলস্রোত হইতে দূরে সরিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের এই আত্মপীড়নের কী প্রয়োজন ছিল?
কেহ বলিতে পারেন, যৌনতা লইয়া দার্শনিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক কচকচি চলিতে পারে, কিন্তু আইনগত প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য বাসস্থান কিংবা বয়সের মতো লিঙ্গও নির্দিষ্ট করিয়া জানাইতে হইবে। না হইলে অনাবশ্যক জটিলতার সৃষ্টি হয়। পিঙ্কির উদাহরণ দিয়াই বলা যাইতে পারে, তিনি পুরুষ হইয়া মহিলা বিভাগে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ লইয়া থাকিলে অপরাধ করিয়াছেন। এ কথাটি বেশ সহজে বোঝা যায়, কিন্তু ইহার উত্তরও সহজ নহে। মন দৃশ্যমান নহে, দেহ দৃশ্যমান, সুতরাং তাহা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের যোগ্য এই ধারণা যদি ঠিক হইত, তাহা হইলে পিঙ্কিকে লইয়া বিশেষজ্ঞরা এত বিভ্রান্তি তৈরি করিতেন না। পিঙ্কির লিঙ্গ নির্ণয়ের জন্য বারাসত হইতে কলিকাতা, কলিকাতা হইতে হায়দরাবাদ যাত্রা করিতে হইত না। কেবল দেহের দৃশ্যমান অংশগুলি নহে, হরমোন, জিন প্রভৃতি পরীক্ষা না করিলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া চলিবে না। কিন্তু নিজের হরমোন বা জিন, কোনওটির গঠন বিষয়ে আমাদের কিছুই জানা নাই। যদি জিন পরীক্ষা করিয়া, ক্রোমোসোমের প্রকার দেখিয়া নির্ণীত হয় যে পিঙ্কি দেহগত ভাবে পুরুষ, তাহা হইলেও প্রশ্ন থাকে, পিঙ্কি নিজে কি তাহা জানিতেন? তাঁহার পিতামাতা সন্তানকে কন্যা বলিয়া আজও বিশ্বাস করেন। পিঙ্কির লিঙ্গ বিষয়ে প্রশ্ন তাঁহার জীবনের ইতিহাস লইয়াই প্রশ্ন তোলে। মহাভারতে শিখণ্ডী পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও ভীষ্ম তাঁহাকে নারী বলিয়া ধরিয়াছেন, যে হেতু পূর্বজন্মে তিনি নারী ছিলেন। অজ্ঞাতবাস কালে অর্জুন এক বৎসরের জন্য নারী হইয়াছিলেন। পুরুষত্ব ও নারীত্বের মধ্যে অভেদ্য প্রাচীর নাই, কোনও কালেই ছিল না। আজ জোর করিয়া সেই কাজটি করিতে গিয়া চিকিৎসক, সংবাদমাধ্যম, এবং কৌতুকপ্রিয় জনতা এক কুনাট্য রচিয়াছে। পিঙ্কি অন্যায় করিয়াছেন কি না, সেই প্রশ্নকে ছাড়াইয়া উঠিতেছে একটি প্রশ্ন: পিঙ্কির প্রতি অন্যায় হইতেছে না কি? |