ছ’ঘণ্টার ব্যবধানে সর্বজিৎ সিংহ হয়ে গেলেন সুরজিৎ সিংহ! তপ্ত হয়ে উঠল ভারত-পাক কূটনীতির আবহ। সর্বজিৎ সিংহের গ্রামের বাড়িতে গত সন্ধ্যার উৎসব বদলে গেল স্তব্ধতায়। গোটা ঘটনাটিকে এক ‘নিষ্ঠুর তামাশা’ হিসেবেই বর্ণনা করছেন সর্বজিতের বোন দলবীর কৌর। চাপে পড়ে আগামী কালই সুরজিৎ সিংহকে মুক্তি দিচ্ছে পাকিস্তান।
সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে কাল সন্ধ্যায় পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম খবর দিয়েছিল, পাকিস্তানের জেলে বন্দি ‘ভারতীয় চর’ সর্বজিৎ সিংহের মৃত্যুদণ্ড রদ করে তাঁকে দেশের ফেরানোর তোড়জোড় করছে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সচিবালয়। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক এ জন্য পাক সরকারকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দনও জানিয়ে দেয়। কিন্তু মধ্যরাতে পাক প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ফরহাতুল্লা বাবর ঘোষণা করেন, ‘কোথাও একটা বোঝার ভুল হয়েছে।’ সর্বজিৎ নয়, আর এক ভারতীয় বন্দি সুরজিৎ সিংহকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বাবরের কথায়, ১৯৮৯ সালেই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইশাক খান সুরজিৎকে ক্ষমা প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু এত দিনেও তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। দিল্লির মতে, তিন দশকের বেশি জেল খাটার পরে সুরজিৎকে আটকে রাখা ‘বেআইনি’। |
মধ্যরাতের এই নাটকের পিছনে ‘নির্দোষ’ ভ্রান্তি নয়, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে বলেই প্রাথমিক ভাবে মনে করছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। ইসলামাবাদের ভারতীয় দূতাবাসের কাছে গোটা ঘটনার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। আগামী ৪ জুলাই বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে সুর চড়ানো হবে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ আজ বিবৃতি দিয়ে সর্বজিতের মুক্তির দাবিতে সরব হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “দু’দশকেরও বেশি সময় পাকিস্তানের জেলে বন্দি সর্বজিৎ সিংহের মুক্তির জন্য পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের কাছে আবার আবেদন জানাচ্ছি।” বিরোধী দল বিজেপির তরফে অবশ্য সর্বজিতের মুক্তি নিশ্চিত করতে না পারার জন্য কেন্দ্রকেই দায়ী করা হয়েছে।
পাকিস্তান নিজে কী বলছে? অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী রেহমান মালিক আজ ‘ক্ষত মেরামতির’ কিছুটা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সুরজিৎ কী ভাবে সর্বজিৎ হয়ে গেলেন, তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। পাক সংবাদমাধ্যমে গত রাতের ঘটনার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। গোটা বিষয়টিকে ‘আন্তর্জাতিক অস্বস্তি’র কারণ হিসাবে বর্ণনা করেছে তারা। কূটনৈতিক শিবিরের একাংশের ধারণা, পাক সেনাবাহিনীর চাপেই গোটা ঘটনাটি ঘটেছে। সেটাকে সামাল দিতে আজ মালিক উচ্চকণ্ঠে পাক সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে বলেছেন, তাঁর দেশের ‘গণতন্ত্র’-কে শক্তিশালী করতে সেনার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তাঁর দাবি, কাল রাতের ঘটনায় সেনার কোনও ভূমিকা নেই। |
তবে দৃশ্যতই কোণঠাসা মালিক আজ স্বীকার করেছেন যে, সর্বজিতের মুক্তির দাবি সংক্রান্ত অন্তত ‘আড়াইশোটি’ বার্তা তিনি প্রতিদিন পেয়ে থাকেন। তাঁর কথায়, “আইন অনুমোদন করলে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” লাহৌর প্রশাসন জানিয়েছে, কাল সকাল দশটায় সুরজিৎ সিংহকে কোট লাখপত জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তার পরে ওয়াঘা সীমান্তে তাঁকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হবে। জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে চরবৃত্তির দায়ে ধরা পড়া সুরজিতের বয়স এখন ৬৯।
সর্বজিতের নাম বলেও কেন পিছিয়ে আসতে হল পাকিস্তানকে? মনে করা হচ্ছে, কাল গোটা দিনই লস্কর-ই-তইবা জঙ্গি আবু হামজার গ্রেফতারি নিয়ে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে থেকেছে ইসলামাবাদ। হামজার গ্রেফতারের কথা প্রকাশ্যে আসার পর আমেরিকা ও অন্য দেশে বিষয়টি নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যায়। হামজার কাছ থেকে কথা আদায় করতে পারলে মুম্বই বিস্ফোরণের সঙ্গে পাকিস্তানের সরাসরি যোগাযোগ যে আবার স্পষ্ট হয়ে যাবে, এমন ব্যাখ্যাই চলতে থাকে সংবাদমাধ্যমে।
এর পরে নজর ঘুরিয়ে দিতেই সর্বজিতের মুক্তি সংক্রান্ত খবর ছড়ানো হয় কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, মধ্যরাতে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে পাক সেনা এবং তার পরেই ‘ভ্রম সংশোধন’ করা হয়।
চাপানউতোর চলছেই। শুধু চোখের জল বাঁধ মানছে না সর্বজিতের বোন দলবীর কৌরের। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধী এবং রাহুল গাঁধীর সঙ্গে সর্বজিতের মুক্তির দাবি নিয়ে দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “আমি আবার পাকিস্তান গিয়ে প্রেসিডেন্ট জারদারির সঙ্গেও দেখা করব।”
|