চাকরি-জীবনে এটাই তো সবচেয়ে চেনা সমস্যা
আমি মাধ্যমিক দিয়েছিলাম নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে কুইজ, নাটক ও আরও অনেক কিছু করেছিলাম এবং শিখেছিলাম। চেয়েছিলাম বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করতে। হায়ার সেকেন্ডারিতে হল না, সায়েন্স নিলাম। নম্বর খারাপ হল না। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লাম। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং কোনওদিন ভালবাসতে পারলাম না। রেজাল্ট হয়তো ভাল পেতাম, কিন্তু সেই টানটা উপলব্ধি করিনি কখনও। ফোর্থ ইয়ারের শেষের দিকে আবার পুরনো লেখার স্বভাবটা চাগাড় দিল। শুরুও করলাম বেশ কিছু এদিক-ওদিক লেখা।
এখন চাকরি করছি সেক্টর ফাইভে। দেখে অবাক লাগল, আমি একা না, অনেকেই হাঁপিয়ে ওঠে এই কি-বোর্ড মাউসের ‘হালকা’ কিন্তু মারণ চাপে। তাও কিন্তু বেরোতে চায় না। গত বছর এই প্রস্তুতিতেই দেখি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে একটা লেখা। খামখেয়ালিপনা আমার বরাবর স্বভাব। সত্যি বলতে, আমি কখনওই নিজের জায়গায় স্থির না, সন্তুষ্ট না। খালি কিছু করতে ইচ্ছা করে। কলেজে থাকার সময় একটি রেডিয়ো স্টেশনে কিছু শো পরিচালনাও করেছিলাম। ‘স্পোর্টস’ আমার পুরনো প্যাশন। এই মার্চে দু’বছর হল চাকরি। কিছু দিনের ভেতরেই আমার ইংল্যান্ড যাবার কথা। কিন্তু আনন্দ পাচ্ছি না। আমি চাই না এই চাকরি। স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট করতে চাই। কী হবে জানি না, নিতে চাই এই রিস্কটা। মা-বাবার পুরো সমর্থন আছে আমার সঙ্গে। দুজনেই আমায় উৎসাহ দিচ্ছেন। তবু নিজে একটা জায়গায় গিয়ে আটকে যাচ্ছি যে, নিজের শান্তিটা আগে দেখব, না কি সমাজের তালে তাল মেলানো উচিত। খুব দোটানায় আছি। অনেক স্বপ্ন ছেড়েছি। লেখা, বাংলা অনার্স পড়া কিছু হয়নি। এটাও কী হবে জানি না। এই চাকরি করে হয়তো অনেক আরামে আছি, কিন্তু শান্তি নেই।
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তোমাকে বলছি
শৌভিক, তোমার যে সমস্যার কথা লিখেছ, সেটা সম্ভবত পেশাদার জীবনের প্রথম পর্যায়ের সবচেয়ে পরিচিত সমস্যা যে পেশায় আছি, সেখানে থাকব, নাকি নতুন পথে হাঁটব? নিজের পেশায় তুমি মানসিক ভাবে তৃপ্ত নও, কিন্তু তাতে যে মাইনে পাচ্ছ, সেটার গুরুত্বও অস্বীকার করতে পারছ না। তুমি লিখেছ, তোমাকে হয়তো অফিস থেকে বিদেশে পাঠানো হবে। এই নিশ্চিত জীবন ছেড়ে অনিশ্চিতের দিকে পা বাড়াবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছ।
অনেকেই বলবেন, চাকরি ছেড়ে ফের পড়াশোনা আরম্ভ করা মানেই অনেকখানি পিছিয়ে যাওয়া ছাত্রজীবনের যে অনিশ্চয়তা তুমি পার হয়ে এসেছ, আবার তাতে ফেরত চলে যাওয়া। সেই পড়াশোনার শেষে কেমন চাকরি পাওয়া যাবে, আজকে তুমি যে সাচ্ছল্য উপভোগ করছ, সেই সাচ্ছল্যের স্তরে পৌঁছোতে কত সময় লাগবে, কোনওটাই তুমি জানো না। ফলে, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়া স্বাভাবিক। কথাটা যে ভুল, তা নয়। কিন্তু, এটা একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। আর এক দিক থেকেও দেখা সম্ভব। তুমি তোমার এত দিনের বিষয় ছেড়ে নতুন করে যে বিষয়টা নিয়ে পড়তে চাইছ, সেটার প্রতি যদি তোমার আন্তরিক টান থাকে, বা যদি শুধু চাকরির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর পথ না ভেবে তুমি পড়াশোনার প্রক্রিয়াটাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করো, তাতে আনন্দ পাও, তবে ব্যাপারটা আর অনিশ্চিত পথে হাঁটা থাকে না। তোমার কাছে এই নতুন পড়াটাই উপভোগ্য একটা ব্যাপার হবে।
তোমার হাতে একটা অদৃশ্য দাঁড়িপাল্লা প্রয়োজন যার এক দিকে থাকবে তোমার বাস্তব, আর অন্য দিকে তোমার ইচ্ছে। তোমায় মেপে দেখতে হবে, পাল্লা কোন দিকে হেলে রয়েছে। তোমার সুবিধে হল, তুমি লেখাপড়া আর চাকরি, দুটো দুনিয়াকেই চেনো। চাকরির দুনিয়া ছেড়ে লেখাপড়ার দুনিয়ায় ফেরত যাবে কি না, জীবনটা নতুন করে আরম্ভ করবে কি না এই সিদ্ধান্ত করার মতো অভিজ্ঞতা তোমার আছে। ভাল করে ভাবো, তার পর সিদ্ধান্ত করো।
তুমি সেক্টর ফাইভের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি করো। সেই চাকরি তোমার কেন ভাল লাগছে না, সেটা তোমার চিঠি পড়ে অনুমান করতে পারছি। এই চাকরিতে তোমার সৃষ্টিশীলতা বিকশিত হওয়ার কোনও সুযোগ চোখে পড়ছে না। মনে রেখো, একটা চাকরি করার পরেও নিজের সৃষ্টিশীলতাকে যথেষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব। এমন অনেকে আছেন, যাঁরা একটা পুরোদস্তুর চাকরি করার পরেও কেউ নাটক করেন, কেউ কবিতা লেখেন, কেউ পর্বতারোহণ করেন। কাজেই, তোমার পছন্দের জায়গা থেকেই পেশা বেছে নিতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
তোমার একটা মস্ত সুবিধে, তুমি দু’বছর চাকরি করে ফেলেছ। কাজেই, তোমার পেশার দুনিয়াটা তুমি বেশ ভাল জানো। তোমার কতটা কাজের চাপ আছে, সেই চাপ সামলে তুমি কী কী করতে পারো সে বিষয়ে তোমার একটা ধারণা রয়েছে। ভেবে দেখো, তুমি নিজের জন্য যা যা করতে চাও, সেটা এই চাকরিতে থেকে তোমার পক্ষে করা সম্ভব কি না। ধরো, তোমার এখনকার চাকরিতে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু, তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় নিশ্চয়ই এমন কাজও আছে, যাতে একটু কম সময় দিলেও চলে। তেমন একটা চাকরি নিয়ে তার পর তুমি যেটা করতে চাইছ, সেটা করা সম্ভব হবে কি? পার্ট টাইম কোর্স হিসেবে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট পড়া যায় কি না, খোঁজ নাও। পার্ট টাইম কাজ হিসেবেই স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট-এ যোগ দাও। দেখো, কাজটা তোমার ভাল লাগছে কি না।
রেডিয়ো জকি থেকে সাহিত্য, স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট অনেকগুলো ইচ্ছের কথা লিখেছ তুমি। তার মধ্যে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টকে পেশা হিসেবে বেছে নেবে কি না, সেটাই এখন তোমার মূল প্রশ্ন। স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টই কেন? ছোটবেলা থেকে তোমার খেলতে ভাল লাগে বলেই? যে কোনও চাকরিই কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরি। প্রতি দিন কার্যত একই কাজ করে যাওয়া যে কোনও চাকরির আবশ্যিক শর্ত। তার একটা অসম্ভব একঘেয়েমি আছে, ক্লান্তি আছে। কাজেই, এখন যে চাকরিটা করছ, সেটা ছেড়ে অন্য চাকরিতে গেলেই তোমার মনের সব চাহিদা মিটবে, এমন প্রত্যাশা সম্ভবত ঠিক নয়। বরং, একটা উল্টো সম্ভাবনা আছে। অনেক চেষ্টা করে, ধকল সয়ে পেশা বদল করার পরও যদি দেখো যে সেই আগের সমস্যাগুলো থেকেই গেল, বড় জোর একটু এ দিক ও দিক হল, তাতে আরও হতাশ হয়ে পড়তে পারো।
হতাশ হবে কি না, তা অবশ্য তোমার ওপরই নির্ভর করছে। সমাজের প্রচলিত ধারণা, একটা ভাল চাকরি পেলে সেই চাকরিটাই করা উচিত। সমাজের যে কোনও ধারণার বিপরীতে হাঁটতে গেলেই খুব মনের জোর এবং নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাস থাকা দরকার। তুমি যদি বিশ্বাস করো যে তুমি যেটা পড়তে চাইছ, যে চাকরি করতে চাইছ, সেটা করলেই তুমি সুখী হবে, একমাত্র তা হলেই নতুন পথে হাঁটো। ধরো, খুব সফল হলে না। কিন্তু তাতে তো তোমার চাওয়াটা মিথ্যে হয়ে যায় না। তুমি অন্তত এটুকু জানবে যে তোমার মন যা চেয়েছে, তুমি সেটাই করেছ। তা হলে আর হতাশা আসবে না। তোমার ভিতর থেকে যদি একটা অন্য পেশার প্রতি আকর্ষণ বোধ করো, এবং সেই আকর্ষণটা যদি নেহাত তাৎক্ষণিক না হয়, একটা দীর্ঘমেয়াদি টান তৈরি হয়, অবশ্যই নতুন পেশা বেছে নাও। নতুন পেশায় যাওয়ার পথটা নিঃসন্দেহে কঠিন। এই পথের শেষ কোথায়, হাঁটতে আরম্ভ করার সময় কারও জানা থাকে না। তোমার বয়স এখন বোধ হয় ২৪-২৫ বছর। এমনও হতে পারে, তোমার বর্তমান চাকরিতে তুমি এখনই যত ভাল অবস্থায় রয়েছ, নতুন পেশায় সেই জায়গায় পৌঁছতে পৌঁছতে তোমার বয়স আরও দশটা বছর বেড়ে গেল। কিন্তু, এই নতুন পেশার প্রতি যদি সত্যিকারের হৃদয়ের টান থাকে, তা হলে সেই পথ হাঁটা, গন্তব্যে পৌঁছনো, সবই এমন আনন্দের, এত প্রাপ্তির হয় যে তার জন্য অনেক কিছু করে ফেলা যায়।

ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়: Haate Haat।

অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.