|
|
|
|
মাটির মানুষ |
|
সংস্কৃত ভাষার প্রসারে নবকুমার
অশোককুমার কুণ্ডু • বৈদ্যবাটি |
|
দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে আলোকবৃত্তে
আসেননি। অথচ, সারা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে রঙিন করে তুলেছেন।
মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। |
কলকাতার বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের নিস্তারিণী চতুষ্পাঠি। রাজ্য সরকারের অনুমোদিত সংস্কৃত শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানেই হাজারো প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সংস্কৃত ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নবকুমার। হুগলির বৈদ্যবাটির চতুস্পাঠি লেনের নবকুমার ভট্টাচার্য। সেই অর্থে ‘টুলো পণ্ডিত’ নন। বাংলা ভাষা নিয়ে এম এ পাশ করেছেন। আবার একই সঙ্গে ব্যাকারণতীর্থ, কাব্যতীর্থ এবং ব্যাকরণাচার্য হয়েছেন। পঞ্চাশ পার এই ‘তরুণে’র সংস্কৃত ভাষার প্রতি ভালবাসা এতটাই গভীর যে রোদ, ঝড় জল উপেক্ষা করে নিত্য অধ্যাপনা করতে আসেন কলকাতায়। কাজের জায়গায় তো বটেই বাড়িতেও স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে কথা বলেন সংস্কৃতে। “দেখুন এমন একটা ভাষা যা অতি সমৃদ্ধ ও প্রাচীন তাকে অবহেলা করাটা একটা সভ্যতারই ক্ষতি। অথচ অনেক আধুনিক শিক্ষার বীজমন্ত্র লুকিয়ে আছে এই সংস্কৃত ভাষার কন্দরে। পশ্চিমের শিক্ষা সংস্কৃতি একে ধাক্কা দিলেও সে দিন খুব দূরে নয়, যেদিন সে নিজেই ধাক্কা খাবে। ইংরেজ প্রশাসক হিসেবে এবং পরবর্তী কালে আমাদের দেশজ প্রশাসকরা বড় ভুল করেছেন। ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে একে প্রায় দুয়োরানি করে রেখে।” সখেদে বললেন নবকুমার ভট্টাচার্য।
তা হলে ওই ভাষার ভবিষ্যৎ?
নবকুমারের মতে, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের পাঠ অসম্পূর্ণ, যদি সংস্কৃত না পড়া হয়। একই ভাবে আয়ুর্বেদ। একই ভাবে বাস্তুশাস্ত্র এমনকী পরিবেশ বিজ্ঞানেরও প্রচুর পাঠ পড়ে আছে এই ভাষার মধ্যে। যা অবহেলিত হয়ে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। সেই সঙ্গে অধ্যাপক মনে করিয়ে দেন যে স্বাধীনতা পূর্বে এবং পরে পরেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিকপালরা প্রত্যেকেই সংস্কৃত পড়েছিলেন। এবং সেই কারণেই তাঁদের কর্মজীবন ছিল অনেক বেশি উজ্জ্বল। কিন্তু পরবর্তী কালে এই ভাষাকে এমন কোণঠাসা করা হল যে সে পড়ে থাকল অন্ধকার টোলের ঘরে। আর যাঁরা চর্চা করতেন তাঁদের ব্যাঙ্গ করে বলা হল ‘টুলো’ পণ্ডিত। তবে এ সবের তোয়াক্কা করেন না নবকুমার। ‘আপনি আচরি ধর্ম...’ এমন বিশ্বাসে পূর্ব মেদিনীপুর থেকে সুব্রত চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রকাশ করে চলেছেন সংস্কৃত ভাষার জন্যে ‘প্রেক্ষাপট’ নামে মাসিক পত্রিকা। বলাবহুল্য যার পুরোটাই নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে। এ ছাড়া নবকুমার বছরে একাধিকবার সংস্কৃত শব্দের পুস্তিকা প্রকাশ করে থাকেন নিজের খরচে। ছোট ছোট পুস্তিকায় প্রকাশ করেন বাংলা-সংস্কৃত শব্দকোষ। প্রায় আড়াই দশক এ ভাবেই সংস্কৃত ভাষা নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন নবকুমার। এ রাজ্যে প্রথম ‘স্পোকেন সংস্কৃত’ কোর্স চালু করেছেন। ভাষার প্রচারে তিন দশক আগেই সংস্কৃত পড়ুয়াদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন সর্বভারতীয় সংস্কৃত সংগ্রাম সমিতি। কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে অন্যান্যদের সঙ্গে গড়ে তুলেছেন পুরোহিত প্রশিক্ষণ শিবির। উদ্দেশ্য, ভাষার সঠিক প্রয়োগ। নিয়মিত প্রকাশ করেন ‘দেবভাষা’ পত্রিকা।
পুরোহিতদের জন্য রয়েছে ‘পৌরহিত্য বার্তা’। দেবভাষার প্রচার ও প্রসারে দীর্ঘ চর্চা ও আন্দোলনের জন্য মহারাষ্ট্র সরকার নবকুমারকে সম্মানিত করেছেন ‘সংস্কৃত পরিষেবা’ পুরস্কারে। কাশীর পণ্ডিত সমাজ এই সংস্কৃতপ্রেমিককে ভূষিত করেছেন ‘মহোপাধ্যায়’ উপাধিতে। পাণিনির ব্যাকারণ ভাবনা নিয়ে বক্তৃতার জন্যে আমন্ত্রিত হয়েছেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, এ ভাষার যৌবন কি ফিরে আসবে? আবার কি তা ফিরে পাবে তার পূর্ণ গরিমা? নবকুমারদের আন্তরিক চেষ্টা এবং সংস্কৃতের প্রতি এ হেন শ্রদ্ধা সেই আশাই জাগিয়ে তুলেছে। |
|
|
|
|
|