মেহদি হাসানের কথা যখন, কিছু গল্প শোনাতেই হবে।
১৯৭৮এর মার্চ মাসে প্রথম কলকাতায় এলেন বটে কিন্তু তার বেশ কিছু কাল আগে থেকেই তিনি বাঙালির কাছাকাছি আসছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সামান্য আগে এখানে শেষ মেহফিল করতে এসে গজল সম্রাজ্ঞী বেগম আখতার কথায় কথায় দিব্যি জানিয়ে গেছিলেন তাঁর মাথার কাছে সব সময় থাকে একজন পাকিস্তানি শিল্পীর কিছু গজলের ক্যাসেট। তা ছাড়া তিনি হরদুপুর পাকিস্তানি রেডিও ধরে শোনার চেষ্টা করেন সেই শিল্পীর গান। এটা শোনা ইস্তক সেই দুপুর বারোটা একটায় চেষ্টা ক’রে ক’রে শুনেও ফেলেছিলাম রেকর্ডে ধরা তেমন কিছু গান।
‘পত্তা পত্তা বুটা বুটা
হাল হমারা জানে হ্যায়।’
‘গুলোমেঁ রঙ্গ ভরে’।
‘অবকে হম বিছড়ে’।
কিংবা
‘বাত করনি মুঝে মুশকিল
অ্যায়সি তো ন থি’।
সত্যি কথা বলতে কী জীবনে এতখানি মুগ্ধ খুব কম হয়েছি প্রথম কোনও শিল্পীকে আবিষ্কার করে। এতটাই পাগল তখন সেই শিল্পী মেহদি হাসানের কণ্ঠে যে খেয়ালই রাখছি না যে ‘বাত করনি’র কবি বাহাদুর শাহ জাফর কী ‘পত্তা পত্তা’র রচয়িতা স্বয়ং মীর তক্কি মীর। কাব্যগুণে এত অপূর্ব, অপ্রতিম শেরগুলোকে তাঁর গায়নে বাস্তবিকই অলৌকিক করে দিচ্ছেন মেহদি।
১৯৭৭-এর গ্রীষ্মে প্রথম কলকাতায় গাইতে এলেন রুনা লায়লা। বাঙালি মেয়ে কিন্তু উর্দু উচ্চারণ কী সাফ! সাংবাদিক বৈঠকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘আমি তো বড় হয়েছি পাকিস্তানের করাচিতে। আর গান বলতে জেনে এসেছি একজনেরই নাম হয়তো আপনারা জানেন না।’ তখন জিজ্ঞেস করতেই হয়েছিল ‘কে তিনি?’ এবং উত্তর এসেছিল ‘মেহদি হাসান।’
এর মাসখানেক পরেই লন্ডন যাই কাজে। এবং একদিন ওখানকার চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ ভারতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে রাতের খাওয়ার নেমন্তন্ন পাই। সঙ্গে একটা বড় ‘সারপ্রাইজ’- মেহদি হাসানের অজস্র রেকডর্র্ করা গান। অকাতরে মজেছিলাম শাহেনশা-এ গজলের গজলে। মাঝখানে শুধু একটা সামান্যই খটকা ছিল ‘রঞ্জিশ হি সহি’ গানটার, ‘রঞ্জিশ’ শব্দটা নিয়ে। ‘রঞ্জিশ’ কি বেদনা, বিরাগ, নাকি অবজ্ঞা? আমাদের এখনকার উর্দু জ্ঞানে ঠিক মানেটা ঠাওরানো গেল না। পার্টির একজন তো ‘রঞ্জিশ’-এর মানে করে ছিলেন ‘ঘৃণা’। তবে সবাই সেদিন আমরা একমত হয়েছিলাম যে মেহদির জন্যই আমাদের সবাইকে উর্দু কবিতা ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করতে হবে। |
যখন মেহদি সাহেব স্বয়ং চলে এলেন ভারতে, সেই দেশ বিভাগের পর বিশ বছর বয়সে রাজস্থানের ভিটেমাটি ছেড়ে পাকিস্তান চলে যাবার পর। প্রথমে মুম্বইতে মেহফিল করেছিলেন কয়েকটা, সেখানে বলিউডের তারকারা ঝাঁকে ঝাঁকে হাজির হতেন। টপ হিরোইন রেখা নাকি আবেগে মূর্ছা যেতেন। আমরা কাগজে কাগজে খবর পেতাম। তার পর হঠাৎ একদিন খবর হল মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে হিন্দি হাই স্কুলে সারারাতের একক জলসা করছেন মেহদি। চোখের সামনে দেখলাম কী অবলীলায় কলকাতাকে কয়েদ করে নিলেন করাচির জিনিয়াস। কখনও শিবরঞ্জনীতে ঈষৎ আলাপ করে কবিতায় এসে, কখনও শুধু গুটি কয়েক অলফাজ বা শব্দকে সুরের তুলি দিয়ে ছবির মতো এঁকে, কখনও শুধু মীড়, মুড়কি বা খটকার অলঙ্কারে ‘হায়! হায়! বহত খুব!’ বা ‘সুহানাল্লার’ ঝড় বইয়ে দিয়ে। অর্থাৎ যাঁরা উর্দু বোঝেন তাঁদের জন্য শব্দের খেলা। আর যাঁরা সুর দিয়ে অনুসরণ করছেন তাঁদের জন্য ওঁর ধ্রুপদ খেয়াল, ঠুংরি, রাজস্থানি লোকসঙ্গীতের তালিমকে কাজে লাগানো। কাব্যসঙ্গীতে আমরা চিরকাল দেখে এসেছি সুর দিয়ে কথার ভাব, রূপ ও মাধুর্যকে ধরার চেষ্টা হয়, সে রাতে সেই রীতির পাশাপাশি আর একটা শিল্পও দেখালেন মেহদি—কবিতার একেকটা কথা দিয়ে তিনি কী ভাবে সুর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গজলের বাণী যেখানে, ‘ইয়ে ধুঁয়াসে কহা সে উঠতা হ্যায়’ মেহদি পুরো হৃদয়ের জ্বলন এবং তার ধোঁয়া ওঠা গেয়ে দেখিয়ে দিলেন। অনেক পরে জেনেছি সুফি গায়িকা আবেদা পারভিনকে শিল্পী নাকি একবার বলেছিলেন, “আমি সুর দেখতে পাই’। জানি না, আমার সেই ছোঁয়াচে উচ্ছ্বাস নাকি সম্পাদকীয় ভেল্কি থেকে একটা গানের আসরের আলোচনাকে বসানো হল প্রথম পৃষ্ঠার অ্যাংকারে। আনন্দবাজারের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম।
এর কিছু দিন পরে ফের একবার কলকতায় এলেন মেহদি সাহেব এবং গাইলেন রবীন্দ্র সদনে। ওঁর তখন একটা সাক্ষাৎকার নিতে যাই আনন্দলোকের জন্য। আমার তখন মাথায় ছিল ভারতের পাক্ষিক পত্রিকায় বলা ওঁর একটা কথা। বলেছিলেন,‘‘দেখা হলে লতাজির কণ্ঠে একটা চুমু দিতে চাই।’’ জিজ্ঞেস করলাম কোনও পুরুষ কণ্ঠে চুম্বন করতে হলে? হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, “এই উপমহাদেশের সেরা কণ্ঠস্বর হেমন্ত কুমারের।’’ এর কিছু দিন পরে হেমন্তবাবুকে কথাটা বলাতে উনিও হেসেছিলেন---ভাল লাগার হাসি। তারপর যখন জিজ্ঞেস করলাম, মেহদির গজলের ওই গায়কিকে কি বাংলা আধুনিকে আনা যায় না? উনি সত্বর উত্তর করলেন, ‘দরকার হবে না। সেটা তো রবীন্দ্রনাথই করে গেছেন ওঁর গানে। ‘সেরা কবিতাকে সেরা সুর দিয়ে খুলে খুলে গাওয়া।’
বাঙালির সঙ্গে মেহদি হাসানের নাড়ির সম্পর্ক বোধহয় এইখানে। শুধু সুর লাগিয়ে প্রাণ উদ্বেল করলেই হবে না। ভাবেরও একটা গন্তব্য চাই। বাঙালির প্রিয় সব রাগও থেকে থেকে ফিরে ফিরে আসে মেহদির প্রিয়তম গানগুলিতে। যেমন বাগেশ্রী,(‘পত্তা পত্তা বুটা বুটা’), ঝিঁঝিঁট (‘গুলোঁ মে রঙ্গ ভরে’), ভূপালী (‘বাত করনি মুঝে মুশকিল’), ভৈরবী ( ন কিসি কি আঁখ কা নূর হুঁ), ইমন (রঞ্জিশ হি সহি) তিলক কামোদ (‘উমর গুমর ঘির আয়ো রে’), এ ছাড়া খাম্বাজ, বেহাগ, দরবারি, তিলং, চারুকেশী, পাহাড়ি, জয়জয়ন্তী। সিনেমার জন্য অন্যের করা কিছু সুর বাদ দিলে অধিকাংশ সুরই শিল্পীর নিজের করা। বিভিন্ন আসরে একই সুরকে ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায়, অলঙ্কারে ধরেছেন, কিন্তু সুরের চেহারাকে বদলাননি।
দেখা গেল মেহদির ওই ’৭৮-এর সফরের পর ভারতে গজল গান শুধু শীর্ষ জনপ্রিয়তাই পেল না কেউ আর গান গাইতেই পারল না মেহদি হাসানের প্রভাব এড়িয়ে। চিত্রা সিংহই বোধহয় জানিয়েছেন হালে যে, সব গজলিয়ার গানেই কিছুটা কিছুটা সেঁধিয়ে আছেন মেহদি। বাঙালি শিল্পী এবং শ্রোতার মধ্যে এক মেহদি ঝড় বয়ে গিয়েছিল আশির দশকে। মানবেন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘ভাই এই হচ্ছে গান। চুপ করে শুধু শুনে যাও।” প্রয়াত নজরুলগীতি গায়ক সুকুমার মিত্র বললেন, “এত অপূর্ব উর্দু উচ্চারণই তো শোনা হয়নি এত কাল।” জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় তাঁর সহজ সরল ভঙ্গিতে এক অনবদ্য কাজ করলেন—মেহদির স্টাইলে ও সুরে নিজের বাংলা কথা বসিয়ে বাংলা গান বেঁধে ফেললেন।
রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুলে অভ্যস্ত বাঙালি কানে মেহদির গজল শুধু মধু ঢেলেছিল ঠিকই, কিন্তু খুব অচেনা ঠেকেছিল কি? কলাবন্ত, ধ্রুপদিয়া ঘরের ছেলে মেহদি সাহেব প্রেমের কবিতাকে প্রেমিকের মতো করে বলার পথ বাতলে গেছেন। প্রথমত উচ্চারণ, দ্বিতীয়ত প্রক্ষেপণ, তৃতীয়ত রস, চতুর্থত পরিমিতি এবং পঞ্চমত দরদ এবং দর্দ অর্থাৎ বেদনা। বাঙালি সহসা আবিষ্কার করল কী এক বিস্তীর্ণ ব্যথার সাম্রাজ্য মেহদির গজলে। দুঃখের জীবনে ভারাক্রান্ত মীর ও গালিব দেশান্তরিত বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর, রাজনীতিতে আন্দোলিত ফৈজ আহমেদ ফৈজ—এঁদের ব্যথার কবিতাকে প্রায়
এক দার্শনিক মর্যাদা অর্পণ করেছেন মেহদি। বড়ে গুলাম আলি খান এবং বেগম আখতারের পর প্রেমের কথা এভাবে তো শোনাই হয়নি বাঙালির। |