পুস্তক পরিচয় ১...
আন্দোলনের আর্কাইভ হয়ে রইল
অন্য অর্থ, সম্পাদনা: শুভেন্দু দাশগুপ্ত, রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর ভট্টাচার্য, প্রণবকান্তি বসু। চর্চাপদ, ১০০০.০০
মি গোড়া থেকেই পত্রিকা ‘অন্য অর্থ’ আর সংকলন ‘অন্য অর্থ’ একটু আলাদা করে নেব। সংকলনের মধ্যে এই আলাদা করার চিন্তা খুব আছে বলে মনে হল না। আমি আলাদা করছি এই কারণে যে, এ দুটো জিনিস এক নয়। ১৯৭৩-এ পত্রিকাটি যখন বেরোয়, তখন সেটা যে-অর্থে যতটুকু হোক, যে-ঘটনা বা যা-ঘটনা ছিল, আজ বই বেরোবার সময় তা কিন্তু আর নেই। সময় বদলে গেছে, মনমেজাজ বদলে গেছে। এ কথাটা মেনে নিতে অসুবিধা হলেও মেনে নিতে হয়। পত্রিকায় যাঁরা জড়িয়ে ছিলেন বা এই সংকলন তৈরিতে যাঁরা জড়িয়ে আছেন, তাঁদের এ কথাটা হয়তো খুব ভাল লাগবে না। কিন্তু এ সব কথার জন্য মন তৈরি রাখতে হয়।
‘অন্য অর্থ’ পত্রিকা যখন বেরোয়, তখন অর্থনীতির ছাত্র-শিক্ষক মহলে নিঃসন্দেহে খানিকটা সাড়া পড়েছিল। তবে সেই সাড়া পড়ার চেহারাটাও আজ এক বার ফিরে দেখা উচিত। অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখার ছাত্রছাত্রীরা পত্রিকায় আগ্রহী ছিলেন। আর কিছু তরুণমনস্ক শিক্ষকও। কয়েকজনের নাম তো সংকলনের ভূমিকাতেই উল্লেখ করা আছে। এর বাইরেও কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁরা এই পত্রিকার তত্ত্বগত ও মনোগত অবস্থান নিয়ে উৎসাহী ছিলেন। উৎসাহের কারণটা আজ সংকলন প্রকাশের দিনে খেয়াল করা দরকার। আমি অর্থনীতি চর্চার বিদ্যায়তনিক চেহারার দিক থেকে কথাটা স্মরণ করার চেষ্টা করছি। পেশাগত ভাবে যাঁরা তখন অর্থনীতির শিক্ষকতায় জড়িয়ে গিয়েছেন, তাঁদের অনেকের ছিল এক ধরনের অসন্তোষ, অস্বস্তি ও অভাববোধ। এই অভাববোধের ইঙ্গিত এই সংকলনের পাঠকও টের পাবেন। কিন্তু যেটুকু অস্বস্তি ও অভাবের কথা এখানে বলা হচ্ছে, ব্যাপারটা ছিল বোধহয় তার থেকে আরও কিছু বেশি। অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই বেশিটুকু কতটা প্রকট ছিল আমি ঠিক বলতে পারব না। কেননা, সেই বেশির অভাব তাঁদের বিদ্যাক্ষেত্রে অনুমান করি কিছু কম ছিল। সংকলনে যে-অভাববোধের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা জড়িয়ে ছিলেন বোধহয় সেটুকুতেই।
কথাটা একটু খুলে বলা যাক। তখনকার পত্রিকা প্রকাশের গরজের কথা বলতে গিয়ে মূলত যে-কথাটা উঠে আসছে, তা হল, প্রচলিত অর্থনীতি চর্চায় যা পাওয়া যেত, তা দিয়ে আমাদের চেনাজানা ধরাছোঁয়ায় বিশেষ সুবিধা হত না। এই প্রসঙ্গে প্রতিতুলনায় কাজ করছে মার্কসীয় অর্থনীতি। অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানী সম্ভবত আকর্ষণ বোধ করেছিলেন এই জায়গাটাতে। ১৯৭৩-এর দুনিয়ায় কলকাতায় তা খুবই স্বাভাবিক ছিল। আমাদের বিদ্যায়তনিক মনে একান্ত ভাবে বাজার-নির্ভর অর্থনীতি চর্চার বেগ ছিল অপ্রতিরোধ্য, আজও তা অপ্রতিহত। মার্কস-চিন্তার হাত ধরে সেই বাজারের আবরণ ভেদ করার যে-দায় ও গরজ, তা ক্লাসঘরে ছিল নিতান্ত অপ্রত্যাশিত। সেই দায় মাথায় নিয়ে কিছু তরুণ যে এ ধরনের একটা কাজে হাত দিলেন, সেটা মনে হয়েছিল খুব জরুরি। একটু ছড়ানো অর্থে যে-অভাববোধের কথা বলছিলাম, তার সবটা কিন্তু এতে মিটবে না। এই অন্য অর্থ আন্দোলনের গোড়া থেকেই আমাদের কারও কারও মনে হচ্ছিল এর চিন্তাপরিধির একটা ঘের বাঁধা আছে। সেটা এমনিতে খুব অস্বাভাবিক কিছু না। সব পরিধিতেই কিছু ঘের থাকে। কিন্তু এখানে মার্কস-কেন্দ্রিক চিন্তাপরিধিকে যে জায়গায় বসিয়ে অর্থনীতির চর্চার সূত্রপাত করা হচ্ছে, তাতে মনে হয়েছিল, জীবনপরিধির এমন অনেক কিছু বাদ যাবে, যে আবার এক ধরনের ভিতরের শূন্যতায় আমরা জড়িয়ে যাব। ষষ্ঠ সংকলনে এসে বিপদটা খানিকটা প্রকাশ্যেই দেখা গেল। ঘোষণা করা হল: ‘‘‘অন্য অর্থ’-এ লেখা পছন্দ হবার শর্ত তিনটি। প্রথমত, মার্কসীয় দর্শনের বিরোধী কোনও লেখা ছাপানো হবে না, দ্বিতীয়ত, লেখার বিষয়বস্তু সামাজিক অর্থনীতির আওতার মধ্যে পড়বে।’’ তৃতীয় শর্তের উল্লেখ এখানে দরকার নেই বলে করলাম না। আমাদের এখানে মার্কসীয় মনের যে-ঘের প্রধানত রাজনৈতিক সংযোগে গড়ে উঠেছে, তাতে সমাজ সংস্কৃতি ও আমাদের মনোজগতের এমন অনেক কিছু বাদ যায় যে তাতে জীবনবৃত্তের বড় একটা অংশ হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। কাজেই সেই ঘেরের সামাজিক অর্থনীতির আওতা থেকেও অনেক কিছু বাদ যাবে।
অর্থনীতিতে গণিতের প্রয়োগ প্রসঙ্গে এখানে যে-সমালোচনার দৃষ্টি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ছিল যথার্থ ও প্রাসঙ্গিক। জেভন্স প্রমুখ অর্থনীতিবিদের যে-প্রেরণায় এখানে গাণিতিক মডেলের বিকাশ হল, তা এল খানিকটা যান্ত্রিক ভাবে। ওই বিমূর্ত চর্চায় সমাজ-সংস্কৃতির বেশ খানিকটা এক ধাক্কায় আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল। প্রথমটা আমরা বুঝিনি যে আমাদের অর্থনীতি শাস্ত্র নীরক্ত হতে বসেছে। ‘অন্য অর্থ’ তা নিখুঁত শনাক্ত করেছিল। এ বাহাদুরি তাঁদের অবশ্য প্রাপ্য। মডেল বানাতে হচ্ছে বলে যে এ ব্যাপারটা ঘটছে, তা তো নয়। তত্ত্ব বানাতে গেলে মডেলের আশ্রয় নিতে হতেই পারে। কিন্তু মডেল বানাবার সময় কোন কোন জিনিস হিসেবে নিচ্ছি আর কোন কোন জিনিস নিচ্ছি না, সে কথাটা জরুরি। কোন জিনিস হিসেবে নেব তা নির্ভর করবে কী আমি জানতে চাই তার ওপর। কাজেই, ঘুরেফিরে প্রশ্নটা এসে দাঁড়াচ্ছে সমস্যাপট বিষয়ে আমার ভাবনা বা অবস্থান কী, তাই নিয়ে। সাম্যাবস্থা-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক তত্ত্বে যা আমি জানতে চাই, তা আমার সমাজজীবন যাপনের দিক থেকে বড়ই সংকীর্ণ। ফলে মন ওঠে না। কিন্তু মার্কসীয় ধারার যে-অর্থনীতির জন্য অন্য অর্থ আন্দোলন ঘের টেনে দিয়েছিল, সে সমস্যাপটেও বা কতটা ধরানো যায়। আমাদের জীবন যে বস্তুত আরও অনেক আঁকাবাঁকা পথে চলে।
এই জায়গায় এসে পড়লে রাজনীতির আরও অনেক কথা এসে পড়ে। অন্য অর্থ আন্দোলন গত শতাব্দীর সত্তর দশকের যে-সময়ের কথা তখন দেওয়ালে দেওয়ালে, সে দশক তখন মুক্তির দশক, চিনের চেয়ারম্যান তখন আমাদের চেয়ারম্যান। যে জীবনবৃত্তে রাজনীতির এ সব কথা তখন উঠেছিল, সেই বৃত্তের অনেক কিছুই কিন্তু তখনই এই রাজনীতির ঘেরের বাইরে চলে যাচ্ছিল। সে কথা হিসেবের মধ্যে ধরতে পারা তখন খুব সহজ কাজ ছিল না। কারণ, ওই রাজনীতির পরম্পরায় সে কথা ঠিক কোনও দিন ঠাঁই পায়নি। মার্কসীয় চিন্তা অভূতপূর্ব ভাবে পঞ্চাশ/ষাট বছরের মধ্যে নানা দেশে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সেই দেশের সংস্কৃতি ও পরম্পরার সঙ্গে সেই চিন্তার মোকাবিলার গল্পটা মোটেই আশাব্যঞ্জক ছিল না। এমনকী মার্কসের রচনারও যতটুকুতে আমাদের হাত দেওয়া সম্ভব, তার মধ্যেও সমাজ রূপান্তরের যে-গল্প উঁকি দেয়, তাও মোটেই সোজাসাপ্টা নয়। আমরা বিপ্লবের ব্যস্ততায় সে দিকে ঠিক মন দিতে পারিনি। আসলে আমাদের বিশ্বজোড়া রাজনীতির যে ঘের তত দিনে রীতিমতো তৈরি ছিল, তার বাইরে বেরোতে গেলে অনেক সংস্কারে ঘা লাগার আশঙ্কা। সে সব পেরিয়ে শক্ত পায়ে দাঁড়াবার জন্য কোনও জমির সন্ধান আমাদের রাজনীতির আঙ্গিকে ধরা পড়েনি। বিকল্প অর্থনীতির তত্ত্বভাবনা রাজনীতি ভাবনার এক মুদ্রা তো বটে। তাই অন্য কোনও পরিসর রাজনীতিতে দেখা না দিলে তা আমাদের অর্থনীতি ভাবনায় দেখা দেবে, এ প্রত্যাশা একটু অলীক।
সমর্থ বাংলা ভাষায় অর্থনীতি রচনার দিক থেকে ‘অন্য অর্থ’ একটা জরুরি কাজে হাত দিয়েছিল। সে চেষ্টায় তাঁদের সাফল্যও খেয়াল করার মতো। ওই সময়ে আরও কিছু পত্র-পত্রিকা এই ধরনের কাজ দরকারি মনে করেছিলেন। রাজনৈতিক প্রেরণা নিশ্চয় এর পিছনে একটা বড় কারণ ছিল। যে জীবনবৃত্ত নিয়ে আমাদের কথাবার্তা, সে জীবনের কাজের জন্য সে মানুষদের ভাষাটা তো অন্তত ছুঁয়ে থাকতে হবে।
বর্তমান সংকলন একটি আন্দোলনের আর্কাইভ হয়ে রইল আমাদের হাতে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.