একটা কথা সত্যি করে বলুন তো লিয়েন্ডার পেজ আর মহেশ ভূপতির মতো আপনার আর সৌমিত্রর মধ্যেও কি কোনও ইগোর সমস্যা হচ্ছে?
(অনেকক্ষণ চুপ) নাহ। থাকলে ১২ বছর একসঙ্গে কাজ করতে পারতাম না।
আর আজকের দিনে? সংসারে তো অশান্তির কালো মেঘ?
না, না, না, একেবারেই নয়। ভূমি কিন্তু ভাঙেনি। হ্যাঁ, মাঝখানে সমস্যা হয়েছিল। আপনাকে যদি কেউ হঠাৎ বলে আপনি তিন মাস অফিস যেতে পারবেন না, আপনার কেমন লাগবে? আমার মনটাও ওই রকম তেতো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা সাময়িক।
কিন্তু এই যে আপনি ভূমি-র বাইরে আলাদা অনুষ্ঠান করছেন, ভূমির বাইরে নিজের একটা আলাদা ইমেজ তৈরির কথা ভাবছেন, ওদিকে সৌমিত্র নতুন ব্যান্ড ‘রবি ও নবীন’ তৈরি করলেনএতে তো ভূমির ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আমি একা অনুষ্ঠান শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলাম গত ডিসেম্বরেযখন সৌমিত্র হঠাৎ তিন মাসের ছুটি নেবে বলে ঘোষণা করে। ভূমির প্রোগ্রাম হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। এ দিকে সেটা পিক সিজ্ন। আমার তো আর ছুটি নিলে হবে না। মিউজিক ইজ মাই ব্রেড অ্যান্ড বাটার। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমায় একা আলাদা অনুষ্ঠান করতে হয়। পরে অবশ্য সে সমস্যা মিটে যায়। কিন্তু তত দিনে আমার একার অনুষ্ঠানের বেশ কয়েকটা বুকিং হয়ে গেছে। সুতরাং করতেই হয়েছিল।
আর এখন যে আলাদা অনুষ্ঠান করব বলে ভাবছি, তার কারণ ভূমির বাইরেও আমার অনেক গান রয়েছেসিনেমার গানই বিশেষত, যেগুলোর জন্য রিকোয়েস্ট আসে। কিন্তু ভূমির প্রোগ্রামে সে সব গান তো আর গাওয়া যায় না। তাই আলাদা অনুষ্ঠানের কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি।
কেন গাওয়া যায় না? ভূমিতে তো বরাবরই সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা গান সুরজিৎ-ই গেয়েছেন আর সৌমিত্র রায়ের লেখা গান সৌমিত্রই গেয়েছেন। সে ক্ষেত্রে আপনার অন্য গান ভূমির অনুষ্ঠানে গাইতে সমস্যা কোথায়?
না, না, সেটা কী করে হবে। ভূমির তো একটা আলাদা ফর্ম আছে। তার বাইরে গিয়ে অন্য ধরনের গান কী করে গাইব।
তা হলে ভূমির ভবিষ্যৎ কী?
ভূমির শো তো বুক হচ্ছে। এই তো সেদিনই আমরা পাঁচজন একসঙ্গে শো করলাম। পুজোর সময়েও দিল্লিতে শো আছে।
তবে হ্যাঁডিসেম্বরে হঠাৎ যে আমাদের মধ্যে একটা স্প্লিট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, সেটার একটা নেগেটিভ প্রভাব পড়েইছিল। আমাদের প্যাচ-আপ হয়ে যাওয়ার পরেও ধারণাটা পুরোপুরি পাল্টায়নি। পাল্টাবার জন্য এবিপি আনন্দে অনুষ্ঠানও করেছিলাম আমরা। এ বার যখন শহর জুড়ে একটা নতুন ব্যান্ডের হোর্ডিং পড়ছে সৌমিত্র আর রবিন (লাই) কে নিয়ে, তাতে কনফিউশনটা আরও বাড়ছে। আমার কাছেই তো বহু ফোন আসছে। একটাই জিজ্ঞাস্যসৌমিত্রদা কি ভূমি ছেড়ে দিল? কনফিউশনটা ক্লিয়ার করতেই হবে।
তবে ১২ বছর ধরে আমরা একসঙ্গে গানবাজনা করছি। দেড় হাজারের ওপর অনুষ্ঠান করেছি। তার পরও যদি ও মনে করে ওর ছেলেকে নিয়ে একটা ব্যান্ড করবে, হু অ্যাম আই টু সে এনিথিং? |
আপনাকে বেশ ক্ষুব্ধ শোনাচ্ছে...
না, না, ক্ষুব্ধ হওয়ার কিচ্ছু নেই। সৌমিত্র কিংবা আমি ভূমির বাইরে দশটা ব্যান্ড করতেই পারি। শুধুমাত্র ভূমিতেই আটকে থাকতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তার মানেই ভূমি ভেঙে গেল এটা মোটেও নয়। আমি আমার কথা বলতে পারিযাই করি না কেন, ভূমি এখনও আমার প্রথম প্রায়োরিটি। আমার ধারণা সৌমিত্রও তাই বলবে।
তাই?
সৌমিত্রর কথাটা ও-ই ভাল বলবে। তবে আমার মনে হয় ভূমির নতুন অ্যালবাম নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসে গেছে।
শেষ অ্যালবাম তো বেরিয়েছিল গত বছর পুজো নাগাদ। কিন্তু তাতে মৌলিক কম্পোজিশন ছিল না।
আমি মনে করি ইট ইজ হাই টাইম। নতুন অ্যালবাম নিয়ে বসা উচিত। এবং তাতে নতুন এবং মৌলিক গান-ই শুধুমাত্র থাকা উচিত। কিন্তু এটাও জানি যে এ বছর ভূমির নতুন কোনও অ্যালবাম বেরোচ্ছে না। কবে বেরোবে, তা-ও জানি না।
শেষ কবে সেই পুরনো দিনের মতো একসঙ্গে মিউজিক সৃষ্টি করেছেন?
(দুঃখের হাসি) অনেক দিন হয়ে গেল বন্ধু। অনেক দিন। প্রায় এক বছর। গত জুলাইতে শেষবার একসঙ্গে বসেছিলাম সবাই। নতুন অ্যালবাম রেকর্ডের আগে। (তারপর গা ঝাড়া দিয়ে) কিন্তু বসতে হবে। খুব শিগগিরি বসতে হবে।
এ বছরই?
(শরীরী ভাষায় ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন) সৌমিত্র তো লম্বা ট্যুরে যাচ্ছে ‘রবি ও নবীন’ কে নিয়ে পুজোর শেষে। এ বছর মনে হয় না বসা হবে।
ভূমির বাকি সদস্যরা? তাদের অবস্থানটা কী?
রবিন ‘রবি ও নবীন’-য়ে বাজালেও ভূমিতেই আছে। হেমন্তও (গোস্বামী) আছে। আবার আমার সঙ্গেও বাজাচ্ছে। অভিজিৎ-ও (ঘোষ) বাজাচ্ছে ভুমির জন্য। ১২ বছর আগে ভূমি তো একটা স্বপ্ন ছিল। আমার কাছে সেই স্বপ্নটা এখনও শেষ হয়নি। সারা পৃথিবীর বাঙালি যে ভাবে আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেনতার সঙ্গে কোনও অবস্থাতেই কম্প্রোমাইজ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
কম্প্রোমাইজ না করা মানে কী? আপনিও তো নিজে ব্যান্ড তৈরি করে ফেলেছেন? অনুষ্ঠানও করছেন...
না, না, সেটা ওই যে আগে বললাম‘ইচ্ছে’র গান, এখন ‘মুক্তধারা’ আসছে, তার গানগুলোকে প্রমোট করার জন্য আলাদা লাইভ শো-য়ের প্রয়োজন আছে। আরও বেশ কয়েকটা সিনেমার সুর দিচ্ছি। সেগুলোকেও প্রমোট করা উচিত। সেটা তো ভূমি-র প্ল্যাটফর্ম থেকে সম্ভব নয়। তার জন্য ভূমির প্রোগ্রাম তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। হবেও না।
আপনার নিজস্ব অনুষ্ঠান আর ভূমির অনুষ্ঠান যদি একই দিনে পড়েকী করবেন?
ডিপেন্ডস অন দ্য অকেশন অ্যাকচুয়ালি। আমার অনুষ্ঠানটা যদি আগে থেকে বুক করা থাকে, আর ভূমিরটা যদি হঠাৎ এসে পড়ে, জানি না কী হবে। তাও বলব প্রায়োরিটি সব সময়েই ভূমি। অনুষ্ঠান হোক আর রেকর্ডিং, ভূমিকে বাঁচিয়েই করেছি। করবও।
তার মানে কি একে অপরকে জানিয়ে আপনারা অনুষ্ঠান নেন? কাজ প্ল্যান করেন?
না, তা নয়।
কেকেআর আইপিএল জয়ের পর ইডেনে যে অনুষ্ঠান হয়েছিল, তাতে তো অন্যান্য ব্যান্ডের সঙ্গে ভূমিও বাজিয়েছিল। আপনি ছিলেন না তো সেখানে?
না, আমি তখন বাংলাদেশে, রেকর্ডিংয়ের কাজে। অনুষ্ঠানটা হঠাৎ এসে যায়। সৌমিত্র ফোন করেছিল বাড়িতে। জানতে আমি কোথায়। কিন্তু অত শর্ট নোটিসে আমি চলে আসতে পারিনি।
অর্থাৎ দু’জনের যোগাযোগের ব্যবধান থেকে যাচ্ছে...
তা তো হচ্ছে। ভূমির সদস্যদের আসলে এখনই বসা দরকার। ব্যান্ডটার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, সেটা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার।
আপনার ‘কবিতা-ক্লাবে’র গেট-টুগেদারে সৌমিত্র এসেছিলেন?
সৌমিত্র কিন্তু কবিতা-ক্লাবের মেম্বার। ও কবিতাও লিখেছে। তবে সেদিন গেট-টুগেদারে আসতে পারেনি। ব্যস্ত ছিল বোধহয়।
আর আপনার একক অনুষ্ঠানে?
না। প্রথম অনুষ্ঠানটা সাউথ পয়েন্ট রি-ইউনিয়নের জন্য করি। তখন সমু বলেইছিল ও আউট অফ বাউন্ডস। বাকি অনুষ্ঠানগুলো হয়েছিল পুরুলিয়া, জয়চন্দ্রপুর, এই সব জায়গায়। সুতরাং সেখানে ডাকার প্রশ্নই ওঠেনি।
আর রবি ও নবীন-এর প্রথম অনুষ্ঠানে আপনি নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন?
অবশ্যই। কিন্তু যেতে পারিনি। ব্যক্তিগত একটা কাজে আটকে পড়েছিলাম।
কিন্তু আপনি তো এবার নিজের আলাদা অ্যালবামের কথাও ভাবছেন?
হ্যাঁ, তা ভাবছি। এবং ১২ বছর পর আবার সোলো অ্যালবাম করা নিয়ে আমি প্রচণ্ড এক্সাইটেড।
সেটার দরকার পড়ছে কেন?
কারণ আমি তো সমানে নতুন গান লিখে যাচ্ছি। সেগুলো আমি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। এ দিকে এই মুহূর্তে ভূমির নতুন অ্যালবাম হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সেটা সরকারি ভাবে ঘোষণাও হয়ে গেছে। সুতরাং আমায় বাধ্য হয়েই নিজের আলাদা অ্যালবামের কথা ভাবতে হচ্ছে।
ভূমির বারান্দায় কি তা হলে অন্ধকার?
না, না, ভূমি একটা স্বপ্নের মতো। ওই বারান্দায় কেবল রোদ্দুরই দেখতে চাই। |