পূর্বে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা
প্রশ্ন নিয়ে অস্বচ্ছতার বহু অভিযোগ
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ-পরীক্ষার পর যে প্রশ্নপত্র জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের তত্ত্বাবধানে থাকার কথা, এখন সেই প্রশ্নপত্রেরই ফোটোকপি জেলার আনাচে-কানাচে হাতে-হাতে ঘুরছে। পরীক্ষার আগেও প্রশ্নপত্রের বিষয়বস্তু প্রকাশ হয়ে পড়েছিল বলে বিভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। এখন প্রশ্নপত্র হাতে-হাতে ঘোরায় পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ডানপন্থী ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’ থেকে বামপন্থী ‘নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’ ও ‘বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেই পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
এই সেই প্রশ্নপত্র। —নিজস্ব চিত্র।
কী করে প্রশ্নপত্র বাইরে বেরোল, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের শিক্ষা-কর্মাধ্যক্ষ দেবব্রত মণ্ডলও। দেবব্রতবাবুর কথায়, “প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ-পরীক্ষা নিয়ে যা কিছু ভূমিকা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদেরই ছিল। পরীক্ষার পরেও যে প্রশ্নপত্র সংসদের তত্ত্বাবধানেই থাকার কথা, তা কী করে বাইরে বেরোলতার উত্তর দিতে পারে সংসদই।” সংসদের চেয়ারম্যান, দেবব্রতবাবুর দল তৃণমূল শিক্ষাসেলেরই নেতা গোপাল সাউও মানছেন, “এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। পরীক্ষার পরে উত্তরপত্রের সঙ্গেই প্রশ্নপত্রও পরীক্ষার্থীদের কাছে থেকে ফেরত নিয়ে নেওয়ার নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষাকেন্দ্রগুলিতে। তার পরেও কোনও কোনও পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে (মোট পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল ৮৪টি) পরীক্ষার্থীরা প্রশ্নপত্র নিয়ে বেরিয়েছেন বলে খবর পাচ্ছি।” তবে গোপালবাবুর দাবি, “এর জন্য পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। কেননা, পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে প্রশ্নপত্র বেরোনো বা না বেরোনোয় কিছু হেরফের হয় না।”
কিন্তু প্রশ্নপত্র সত্যিই পরীক্ষার পরে বেরিয়েছিল নাকি আগেইসে নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে। সংসদের নির্দেশ উপেক্ষা করে পরীক্ষার পরে কোনও পরীক্ষাকেন্দ্র কেনই বা পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র দিয়ে দিতে যাবে (যেখানে উত্তরপত্রের সঙ্গেই প্রশ্নপত্র জমা নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল)সে প্রশ্নও উঠছে। অনেকে বরং পরীক্ষার আগে থেকেই জেলায় রটে যাওয়া প্রশ্নপত্র-ফাঁসের ‘খবর’ই আরও বেশি করে বিশ্বাস করছেন। তাঁদের কথায়, “যা রটে তার কিছুটা তো বটেই!” সব-মিলিয়ে সংসদের নেওয়া পরীক্ষা ঘিরে অস্বচ্ছতার অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে।
এ নিয়ে তদন্তের দাবি তুলেছেন ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’র পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক অরূপকুমার ভৌমিক। অরূপবাবুর অভিযোগ, “গত রবিবার, ১৭ জুন, পরীক্ষার দিন পরীক্ষাকেন্দ্রগুলির সামনেও একদল লোক এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল, সম্ভাব্য প্রশ্ন ও তার উত্তর বলছিলযা পরে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যেতে দেখা গিয়েছে। বিষয়টি সোমবারই ব্যক্তিগতভাবে আমি সংসদ-চেয়ারম্যান গোপাল সাউয়ের নজরে আনি। গোপালবাবু পুরো বিষয়টি গুজব বলে ওড়াতে চাইলেও পরে দেখছি প্রশ্নপত্রও অনেক জায়গায় হাতে-হাতে ঘুরছে। গোটা পরীক্ষা-ব্যবস্থার গোপনীয়তা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।”
বামপন্থী শিক্ষক সংগঠন ‘বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’র জেলা সম্পাদক নারায়ণ বেরার অভিযোগ, “১৭ জুন পরীক্ষার দিন পাঁশকুড়ার রাতুলিয়া বাজারে এক ভদ্রমহিলা সকাল ১০টা নাগাদ (পরীক্ষা ছিল ১২টা থেকে ১টা) হন্তদন্ত হয়ে একটি বইয়ের দোকানে হাজির হয়ে সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের উপর বইয়ের খোঁজ করতে থাকেন। দোকানির প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রমহিলা জানান, তাঁর মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষক-নিয়োগের পরীক্ষার্থী। তিনি শুনেছেন রাধাকৃষ্ণণের উপর রচনা আসছে পরীক্ষায়। তাই বইয়ের খোঁজে এসেছেন। দেখা যায়, সত্যিই রাধাকৃষ্ণণের উপর রচনা পরীক্ষায় এসেছে!” নারায়ণবাবুর আরও অভিযোগ, “বেলা ১১টা নাগাদ হলদিয়ার একটি পরীক্ষাকেন্দ্র থেকেও এক পরীক্ষার্থী আমার কাছে ফোন করে রাধাকৃষ্ণণ নিয়ে জানতে চান। তিনিও বলেন, রাধাকৃষ্ণণের উপরে রচনা আসছে বলে তিনিও পরীক্ষাকেন্দ্রে সবাইকে বলাবলি করতে শুনছেন।” নারায়ণবাবুও বিষয়টি সংসদ-চেয়ারম্যান গোপালবাবুকে জানিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও গোপালবাবু বিষয়টি ‘গুজব’ বলেই উড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ। নারায়ণবাবুর দাবি, “এখন তো প্রশ্নপত্রও বাইরে বেরিয়েছে দেখছি। সে পরীক্ষার আগেই হোক বা পরেই হোক। যে প্রশ্নপত্র সংসদের হেফাজতেই থাকার কথা তা কী করে বেরোলঅবশ্যই তার তদন্ত প্রয়োজন। গোটা পরীক্ষাটাই তো প্রহসন মনে হচ্ছে।” একই রকম অভিযোগ তুলেছেন সর্ববৃহৎ বামপন্থী শিক্ষক সংগঠন ‘নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি’ও। সংগঠনের জেলা সম্পাদক নুরুল হকের কথায়, “প্রশ্নপত্রের বিষয়বস্তু পরীক্ষার আগেই প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল, এমন অভিযোগ আমরা আগেই করেছিলাম। এখন প্রশ্নপত্র বাইরে দেখা যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। অভিযোগের সত্যতা থাকলে প্রহসনে পরিণত হওয়া পরীক্ষা বাতিলের দাবি অবশ্যই তোলা হবে।”
এর সঙ্গেই ৪৪ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ১০ হাজারের গরহাজিরা, পরীক্ষার অ্যাডমিট-কার্ডে পরীক্ষাকেন্দ্রের ঠিকানায় অস্পষ্টতার কারণে অনেক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে না-পারা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। এ ছাড়াও অ্যাডমিট-কার্ড পাঠানোর আগে যোগ্যতা-যাচাইয়েও বড় ফাঁক থেকে গিয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মাধ্যমিকে ৬৪.৫ শতাংশ নম্বর থাকলে তবেই যেখানে আ্যাডমিট-কার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই জেলায়সেখানে মাধ্যমিকে ৫০ শতাংশের কম নম্বর পাওয়া অনেকেও পরীক্ষায় ডাক পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আনন্দবাজারের কাছেও সে-রকম কিছু নথি/তথ্য এসেছে। আবেদনের সঙ্গে মার্কশিটের ফোটোকপি দেওয়ার দরকার না-থাকায় আবেদনপত্রের নির্দিষ্ট কলামে চাকরি-প্রার্থীদের কেউ কেউ ইচ্ছেমতো নম্বর বাড়িয়ে সেটাই ‘কোনও ভাবে’ প্রত্যয়িত (অ্যাটেস্টেড) করিয়ে জমা দিয়েছিলেন এবং সংসদ যাচাই না করেই অ্যাডমিট-কার্ড পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেকে আবার অ্যাডমিট-কার্ড না-পাওয়ার অভিযোগও করেছেন। সংসদ চেয়ারম্যান গোপালবাবু ‘সবই গুজব’ বলে ওড়াতে চাইলেও পরিস্থিতি কিন্তু জটিল থেকে জটিলতরই হচ্ছে। এমনকী মামলা-মোকদ্দমার এবং তার জেরে পরীক্ষাটাই না বাতিল বলে ঘোষিত হয়এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। তৃণমূলের বাধায় দু’বছর আগে পণ্ড হওয়া পরীক্ষা যা-ও বা হল, তৃণমূলের আমলেই সে নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ ঘিরে অসন্তোষ ছড়াচ্ছে পুরো শিক্ষামহলেই। যা পঞ্চায়েত ভোটের আগে শাসকদলকে বেকায়দায় ফেলতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.