পরিবেশের ক্ষতি না করে স্থায়ী উন্নয়নের স্বার্থে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিকে অর্থ ও প্রযুক্তিগত সাহায্য দেওয়ার প্রশ্নে ধনী দেশগুলির রাজনৈতিক অনীহা প্রকাশ্যে এসে যাওয়ায় মুখ খুললেন উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিরা। ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলির ভূমিকার সমালোচনা করে আজ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বললেন, “অর্থ ও প্রযুক্তিগত সাহায্য পেলে পরিবেশ রক্ষা করে স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে বহু দেশ আরও পদক্ষেপ করতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, ধনী ও শিল্পোন্নত দেশের তরফে সে রকম সাহায্যের দৃষ্টান্ত বিরল। বরং চলতি অর্থনৈতিক সংকট সেই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।”
তা হলে ১৯৯২ সালে প্রথম রিও ‘বসুন্ধরা সম্মেলন’-এর পরে কুড়ি বছরে পরিবেশ রক্ষা তথা গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি কতটা হল? ‘রিও +২০’ সম্মেলনে তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, কার্যত কিছুই হয়নি। তবে রাষ্ট্রপুঞ্জে নয়াদিল্লির প্রতিনিধি মনজিৎ সিংহ পুরী আজ বলেন, “ইতিবাচক এইটুকু যে, উন্নত দেশগুলির উপর চাপ অব্যাহত রাখা হয়েছে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিকে অর্থ ও প্রযুক্তিগত সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে রিও-র খসড়া ঘোষণায় দু’টি পৃথক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। আশা করা যায়, বিশ্ব অর্থনীতির কপাল ফিরলে সে ব্যাপারে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে।”
২০ বছর আগে রিও বসুন্ধরা সম্মেলনে বলা হয়েছিল, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলি যাতে পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রেখে স্থায়ী উন্নয়ন করতে পারে সে জন্য উন্নত দেশগুলি সাহায্য করবে। উন্নত দেশগুলি তাদের গড় জাতীয় উৎপাদনের ০.৭ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ করবে। যাতে পিছিয়ে পড়া দেশগুলি আরও বেশি করে তাদের নাগরিকদের দারিদ্র দূর করতে পারে। কেননা দারিদ্রের কারণেই দূষণ বাড়ে। আবার সেই দারিদ্র দূর করতে শিল্প ও পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। সে জন্য যেমন অর্থ সাহায্য জরুরি তেমনই শিল্পায়ন ও উন্নয়নের ফলে যে দূষণ হচ্ছে তা কমাতে ‘সবুজ প্রযুক্তি’ দরকার। কিন্তু গত কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, উন্নত ও শিল্প সমৃদ্ধ দেশগুলি সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। উল্টে এখন যে ভাবে বিশ্বজনীন মন্দার প্রেক্ষিতে উন্নত দেশগুলির অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে তাতে তারা আরও গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। এতটাই যে, ১৩০ জন রাষ্ট্রনেতার উপস্থিতিতে এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে গরহাজির থেকেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল।
এমন একটা পরিস্থিতিতে গত কাল সরব হয়েছিলেন চিনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও। আজ সেই একই সুরে সরব হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীও। রিও শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আজ মনমোহন সিংহ বলেন, “সার্বিক বৃদ্ধি ও মাথা পিছু আয় বাড়ানো উন্নয়নশীল দেশগুলির অগ্রাধিকারের বিষয়। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখা অগ্রাধিকারের তালিকায় এর পরে আসে।” আর এ কথার মধ্যে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আজ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, পরিবেশ রক্ষা তথা দূষণ কমানোর জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের বেঁধে দেওয়া কোনও সময়সীমা বা লক্ষ্যমাত্রার বাধ্যবাধকতা মানতে নারাজ নয়াদিল্লি। বরং দ্রুত শিল্পায়নের জন্য দূষণ হবে। কিন্তু কোনও বাধ্যবাধকতা মানতে না চাইলেও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে স্বেচ্ছায় দূষণ কমাতে আগ্রহী ভারত। সে জন্য ২০২০ সালের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ দূষণ কমানোর লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
শুধু ভারত নয়, লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার বিরুদ্ধে সবকটি উন্নয়নশীল দেশ রিও সম্মেলনে এককাট্টা হয়েছে। তাই খসড়া ঘোষণায় তাদের মতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রিও সম্মেলনে বেজিং, নয়াদিল্লির সেটাই সাফল্য। পাশাপাশি অর্থ ও প্রযুক্তিগত সাহায্যের জন্য চূড়ান্ত খসড়ায় উন্নত দেশগুলির দায়বদ্ধতার কথা আবারও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে এ বারের রিও সম্মেলনে। সেটাও উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলির সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। সম্মেলনে সেই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আজ বলেন, “পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব সকলের। সেই দায়িত্ব উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের সমান হতে পারে না।” বর্তমান সম্মেলন এই নীতিতে আস্থা রাখায় নয়াদিল্লি খুশি। আবার কোনও চাপের কাছে নতি স্বীকার না করলেও দূষণ নিয়ন্ত্রণে নয়াদিল্লির আগ্রহ তুলে ধরতে মনমোহন আজ জানিয়েছেন, ভারতে ছোট ও মাঝারি শিল্পে দূষণ কমাতে সরকার এ বার ব্যবস্থা নেবে। এ জন্য ওই সব শিল্পে ‘সবুজ প্রযুক্তির’ প্রয়োজন। এবং তার খরচের ভার উৎপাদকের ওপর চাপিয়ে দিলে পণ্যের দাম বাড়বে। তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রযুক্তি উন্নয়নে কেন্দ্রই আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। |