নম্বর চাই। আরও নম্বর। কীসে মিলিবে? এই পর্যন্ত আসিয়া প্রশ্নটি থমকাইয়া যায়, কারণ, ইহার উত্তর একাধিক হইতে পারে। যত মত, তত পথ। পরীক্ষার্থীদের আরও সুশীল হইতে হইবে? অধ্যয়নকে তপস্যা করিতে হইবে? শিক্ষকদের আরও যত্নবান হওয়া জরুরি? সম্প্রতি এই লক্ষ্যে একটি নিদানের কথা শুনা গিয়াছে। নম্বর বাড়াইবার সহজ উপায়: ‘অবজেক্টিভ’ অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় স্তরের বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের মাত্রা যাহাতে বৃদ্ধি পায়, সেই লক্ষ্যে পরীক্ষায় মোট নম্বরের অর্ধেকই ‘অবজেক্টিভ’ প্রশ্ন হউক, এমন একটি প্রস্তাব আসিয়াছে। প্রস্তাবক রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং। এই মর্মে তিনি সংশ্লিষ্ট নানা বিভাগের কর্তাদের সহিত কিছু প্রয়োজনীয় আলোচনাও করিয়াছেন। ইহা এক প্রকার শিক্ষা সংস্কারের প্রস্তাব। কিন্তু, সংস্কারটি প্রয়োজনীয় কি? সম্ভব কি? কত দূর সম্ভব? বিষয়গুলি ভাবনার দাবি রাখে।
পরীক্ষায় প্রশ্ন কখনও ব্যাখ্যাধর্মী হয়, কখনও সংক্ষিপ্ত-উত্তরধর্মী হয়, কখনও প্রদত্ত একাধিক উত্তরের ভিতর কোনও একটিকে বাছিয়া লইয়াও উত্তর প্রদান করা সম্ভব। নম্বর মিলিবে। কখনও পূর্ণ নম্বর, কখনও আংশিক। এই বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের ভিতর দিয়া পরীক্ষার্থীর বিবেচনা, পাঠ্য বিষয়ের উপর দখল এবং উপস্থিত বুদ্ধির পরীক্ষা লওয়া হয়। দীর্ঘায়িত উত্তরে পরীক্ষার্থীর বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। সংক্ষিপ্ত উত্তর দ্রুতমনস্কতা দাবি করে। অসাধু উপায়ে সংক্ষিপ্ত উত্তরের ক্ষেত্রে পূর্ণ মান লাভ করা সম্ভব। দীর্ঘায়িত উত্তরে বিষয়টি তত সহজসাধ্য নহে। নিজস্ব বোধ একটি ন্যূনতম মাত্রায় না থাকিলে এই ধরনের উত্তর প্রদান অসম্ভব। এই রূপে, দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত উভয় ধাঁচের প্রশ্নের মাধ্যমে পাঠ্য বিষয়টির যথাসাধ্য সামগ্রিক একটি মূল্যায়ন সম্ভব হয়। অর্থাৎ, উভয় ধরনের প্রশ্নেরই নিজস্ব উপযোগিতা আছে। এবং, সমগ্র ভাবে ‘পরীক্ষা’ বস্তুটি হইল পরীক্ষার্থীর যোগ্যতা বিচারের প্রক্রিয়া। যেন তেন প্রকারেণ তাহাকে নম্বর উপহার দিবার পদ্ধতি নহে।
শিক্ষামন্ত্রী একটি সম্ভাবনার কথা বলিয়াছেন। সেই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা চলিতে পারে। সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন আরও অধিক সংখ্যায় থাকিবে কি না, তাহা একটি প্রশ্ন। কথা হইল, সেই সব বিবেচনার ভিত্তিটি কী হইবে? ‘সি বি এস ই’ বা ‘আই সি এস ই’ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীরা তুলনায় অধিক নম্বর লাভ করেন, মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় করেন না, তাই মাধ্যমিক সংস্থার পরীক্ষাতেও প্রচুর সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন থাক, যাহাতে প্রাপ্ত নম্বরের শতাংশ বৃদ্ধি পায় ইহা কোনও সদর্থক ভাবনার ইঙ্গিত হইতে পারে না। ইহাও ভাবিবার কথা যে পরীক্ষার প্রশ্ন প্রকৃত অর্থে সামগ্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতিরই অঙ্গ। যদি পরীক্ষাকে নিবিড় ভাবে সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক করিতে হয়, তাহা হইলে শিক্ষাদান ব্যবস্থারও পরিবর্তন জরুরি। সমগ্র মানসিকতারই একটি মৌলিক বদল দরকার। সেই সব কিছুই না করিয়া পরীক্ষাকে নিছকই নম্বর উৎপাদন করিবার কল ভাবিলে কাজের কাজ হওয়া কঠিন। সংশয় জাগে, তেমনই একটি মনোভাব কি এই প্রস্তাবের অন্তরালে বিদ্যমান? যদি কোনও মৌলিক শিক্ষা সংস্কারের কথা ভাবিতেই হয়, তাহার অগ্রপশ্চাৎ যথাযথ বিবেচনা করা জরুরি। কোনও কাজ ‘সি বি এস ই’ বা ‘আই সি এস ই’ বোর্ড করে কিংবা করে না, স্রেফ ইহাই কিন্তু কোনও তৎপরতার কারণ হইতে পারে না। অন্তত, হওয়া উচিত নহে। |