রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রশ্নে ইউ পি এ, এন ডি এ এবং বামফ্রন্ট, তিনটি শিবিরের কোনওটিই সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ থাকিতে পারিল না, ইহা নিশ্চয়ই লক্ষণীয়। কিন্তু অন্য দুই জোটের তুলনায় বামফ্রন্টের বিভাজন ঈষৎ ভিন্ন গোত্রের। সি পি আই নেতৃত্ব এখনও জরুরি অবস্থার কালে কংগ্রেসকে দলের অন্ধ সমর্থনের বিরূপ গণ-প্রতিক্রিয়া স্মরণ করিয়া শিহরিত হন। আর এস পি ‘রেভলিউশনারি’ সোশালিস্ট পার্টি বাস্তব রাজনীতিতে সি পি আই এমের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল হইলেও নিজেকে সর্বদাই বিশুদ্ধতর ‘বিপ্লবী’ বলিয়া প্রচার করিয়া থাকে। লিয়ন ট্রটস্কির ‘নিরন্তর বিপ্লব’-এর তত্ত্ব বহু কালই অতীতের গর্ভে বিলীন, ভারতে তাহা অনুশীলনের প্রশ্নও নাই, তথাপি বিপ্লবিয়ানা অতি বিষম বস্তু। ফরওয়ার্ড ব্লকের এই সব সমস্যা নাই সে গাঁধীজিও নাই, সেই সুভাষচন্দ্রও নাই বরং ‘জাতীয়তাবাদী’ ভাবমূতির্র সহিত প্রণববাবু দিব্য মিলিয়া গিয়াছেন। সর্বোপরি, এই বিভাজনে ভোটের অঙ্কে উনিশ-বিশ হইবে, নির্বাচনী পরিণামে প্রভাব পড়িবার কোনও কারণ নাই। এবং ইহার ফলে বামফ্রন্টের সংহতিতে টোল পড়িবার আশঙ্কাও নাই। সেখানেই অন্য দুই শিবিরের বিসংবাদের সহিত ইহার পার্থক্য।
এই বৃত্তান্তের প্রকৃত তাৎপর্যপূর্ণ অংশটি হইল সি পি আই এমের সিদ্ধান্ত। দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। প্রধানত বাঙালি এবং অ-বাঙালি তথা পশ্চিমবঙ্গ (ও ত্রিপুরা) এবং কেরল-এর ভিত্তিতে, যদিও সম্পূর্ণত নয়। সেই দ্বন্দ্ব নিরসনের দায়িত্ব ছিল সাধারণ সম্পাদকের উপর। প্রকাশ কারাট সেই দায়িত্ব বুদ্ধিমত্তার সহিত নির্বাহ করিয়াছেন। মনে করিবার কারণ আছে যে, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি ‘নব্য-উদারপন্থী’ ইউ পি এ-র প্রার্থীর বিরোধী, চাহিলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে গরিষ্ঠতার জোরে তাঁহার অপছন্দ অনুমোদন করাইয়া লইতেও পারিতেন। কিন্তু সে পথে না-গিয়া, কংগ্রেসের সহিত তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধ বাড়াইয়া তোলার এবং বাঙালির আবেগকে আহত না-করার আলিমুদ্দিনি যুক্তি শিরোধার্য করিয়া কারাট কার্যত নিজ দলের মধ্যে বিভাজন ঠেকাইতেও সমর্থ হইয়াছেন। পরমাণু চুক্তি কাহিনির তুলনায় কারাটের এ বারের অবস্থান অনেক বেশি বিচক্ষণতাপ্রসূত। হয়তো তিনি ঠেকিয়া শিখিয়াছেন। হয়তো বঙ্গীয়, সুতরাং জাতীয় রাজনীতিতে দলের বেহাল অবস্থাই তাঁহাকে উদার হইতে বাধ্য করিয়াছে। কিন্তু নেট ফল ইহাই যে, ব্যক্তি প্রকাশ কারাট অপেক্ষা দলের সাধারণ সম্পাদক বড় হইয়া উঠিয়াছেন। সাধু। ‘পশ্চিমবঙ্গ বনাম কেরল’ বিভাজনটি আদর্শগত বিরোধ নয়। ‘বেঙ্গল লাইন’ এবং ‘কেরল লাইন’ বলিয়া কিছু নাই। এই বিভাজন নির্বাচনী রাজনীতির প্রয়োজন হইতে সঞ্জাত। কেরলে সি পি আই এমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মনোনয়নের বিরোধিতা করিয়া দুই রাজ্যের সি পি আই এমকে মুখোমুখি দাঁড় করাইয়া দিয়াছেন। প্রকাশ কারাট এ যাত্রা সামাল দিয়াছেন বটে, কিন্তু সঙ্কটের মূলে আছে একই দলের বিবিধ স্বার্থ, যাহা অনেক সময়েই পরস্পরবিরোধী। এ সমস্যা সি পি আই এমের একার নয়, সাধারণ ভাবেই সর্বভারতীয় দলগুলির। এই দ্বন্দ্ব বা বিরোধ প্রায়শই ওই দলগুলির জাতীয় নেতৃত্বকে সঙ্কটে ফেলিয়া থাকে। একই দল যদি রাজ্যে রাজ্যে রাজনীতি করে, নির্বাচনী প্রচার ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়, তবে এই সমস্যাটি থাকিয়াই যাইবে। প্রকৃত সমাধান একটিই এমন ব্যবস্থা করা, যেখানে জাতীয় স্তরে যে দল রাজনীতি করিবে, রাজ্য স্তরে সেই দল সেই একই পরিচিতিতে রাজনীতি করিতে পারিবে না। অর্থাৎ স্বার্থের স্বাতন্ত্র্য সরাসরি দলের স্বাতন্ত্র্যে স্বীকৃত ও নিহিত হইবে। তাহার পরেও পশ্চিমবঙ্গের সি পি আই এম এবং কেরল সি পি আই এম অবশ্যই কেন্দ্রীয় সি পি আই এমকে বাহির হইতে প্রভাবিত করিবার চেষ্টা করিতে পারে। ভয় কী? প্রকাশ কারাট তো আছেন! |