রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেসের মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থনের প্রশ্নে সিপিএম এবং বামফ্রন্টের অন্দরে মতভেদ ছিলই। সিপিএম শেষ পর্যন্ত প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এ বার বাম শিবিরের অন্দরের ফাটল আরও প্রশস্ত হল! সিপিএম পলিটব্যুরোর ওই সিদ্ধান্ত দলের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে দল থেকে ইস্তফা দিলেন ‘তরুণ-তুর্কি’ এবং তাত্ত্বিক নেতা প্রসেনজিৎ বসু। এ কে জি ভবনের কেন্দ্রীয় কমিটির ইউনিটে কর্মরত এবং দলের গবেষণা শাখার আহ্বায়ক প্রসেনজিৎ যে হেতু প্রকাশ ও বৃন্দা কারাটের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত, তাই তাঁর এই সিদ্ধান্তে সিপিএমে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে!
পদত্যাগপত্রে প্রসেনজিতের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রণবকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত দলের পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রণনীতির উল্টো পথে হাঁটার সমান। তাঁর মতে, প্রণবকে সমর্থনের ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ আখেরে দলের ক্ষতি করবে। ইতিপূর্বে একাধিক ঘটনায় দলের অন্দরে আলিমুদ্দিনের নেতাদের প্রবল সমালোচক ছিলেন প্রসেনজিৎ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, পদত্যাগপত্রেও প্রকারান্তরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদেরই কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা করেছেন এই তাত্ত্বিক নেতা। বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘জোর করে’ জমি অধিগ্রহণ, নন্দীগ্রামে গুলিচালনা, ইউপিএ-১ সরকারকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে আলোচনা করতে যেতে দেওয়ার মতো একের পর এক ‘ভুল’ সাম্প্রতিক কালে দল করেছে। পরে দলীয় সম্মেলনে দলের তরফে সেই ‘ভুল’ স্বীকার করে নিলেও তার জন্য কারও ‘দায়’ নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং তা থেকে শিক্ষাও নেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপতি পদে অতীতে শঙ্করদয়াল শর্মা বা প্রতিভা পাটিলকে বামেদের সমর্থনের সঙ্গে প্রণবের পক্ষে দাঁড়ানোর কোনও তুলনাই হয় না বলে যুক্তি দিয়ে প্রসেনজিৎ দলকে জানিয়েছেন, এই ‘বিরাট ভুলে’র প্রতিবাদে তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন।
রাষ্ট্রপতি পদে প্রণবকে সমর্থনের পক্ষে এককাট্টা ছিলেন আলিমুদ্দিনের নেতারা। তাঁদের পক্ষে ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি (ঘটনাচক্রে, যিনি এখন লন্ডনে)। সিপিএমেরই একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, নিজে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েও আসলে কারাট-ঘনিষ্ঠ প্রসেনজিৎ নিশানা রাখতে চেয়েছেন আলিমুদ্দিনের নেতাদের দিকে। যাতে প্রণবকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভবিষ্যতে কারাটেরা দলের অন্দরে বিতর্ক চালাতে পারেন। আবার তাঁকেও ‘বুঝিয়ে’ ফোরানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে দলেরই একটি বড় অংশ প্রসেনজিতের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অন্য কারণে। দলীয় নেতৃত্বের কাছে শুক্রবার সকালেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে প্রসেনজিৎ পরে ‘আপলোড’ করেছেন একটি ওয়েবসাইটে, যেখানে তাঁর মতো তাত্ত্বিক নেতারা নিয়মিত লেখক। যার জেরে ওয়েবসাইটে প্রসেনজিতের পক্ষে দাঁড়ানোর সঙ্গে জেএনএউ-এ তাঁর ‘এসএফআই-অতীত’ নিয়ে কটাক্ষ করে মন্তব্যও জমা পড়েছে! সিপিএমের একাংশের বক্তব্য, এ ভাবে পদত্যাগপত্র প্রকাশ্যে এনে ফেলা দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। প্রসেনজিৎ-বিতর্ক সামাল দিতে চাইলেও কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে সাধারণ সম্পাদক কারাটকে।
এই পরিস্থিতিতে ফ্রন্টের ‘অস্বস্তি’ আরও বাড়িয়েছে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক। কলকাতার মহাজাতি সদনে এ দিন দলের প্রতিষ্ঠা দিবসের সভায় অশোক ঘোষ, হাফিজ আলম সৈরানির মতো ফ ব নেতারা মন্তব্য করেছেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে সিপিআই এবং আরএসপি-র সিদ্ধান্ত ‘দুর্ভাগ্যজনক’। কারাটের মতো তাঁদেরও যুক্তি, রাষ্ট্রপতি-পদে কংগ্রেসের প্রার্থীকে বামেদের সমর্থন ‘নব্য উদারনীতির জমানা’তেও নতুন কিছু নয়। এই সময় ‘বিভক্ত’ হয়ে পড়ার যে ‘বার্তা’ বামপন্থীরা দিলেন, মানুষ তা ‘ক্ষমা’ করবেন না বলে দুই শরিককে পরোক্ষে আক্রমণই করেছেন অশোকবাবুরা। |