|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
খুঁজে পাওয়া যায় গভীর চিন্তা ও বিশ্লেষণ |
সম্প্রতি আকার প্রকার-এ অনুষ্ঠিত হল ‘এনডিওরিং লিগেসি’ শীর্ষক সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
এখনকার শিল্পীদের কাজে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার কী ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে এই ভাবনা থেকে ‘আকার প্রকার গ্যালারি’ একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত ‘এনডিওরিং লিগেসি’ শিরোনামে এই প্রদর্শনী দেখানো হয়েছিল প্রথমে জার্মানিতে। সম্প্রতি সেটি কলকাতায় দেখানো হল আইসিসিআর-এর ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর’ সেন্টারে। ১৩ জন শিল্পী অংশ নিয়েছেন এই প্রদর্শনীতে ছবি, ভাস্কর্য, ইনস্টলেশন ও ভিডিও নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও সৃজনের জগৎ এতই বিস্তৃত ও বৈচিত্রময় যে, যে-কোনও কিছুকেই তার মধ্যে কোনও না কোনও ভাবে স্থাপন করা যায়। সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রস্মরণের আতিশয্যে এমন অনেক কিছু ঘটছে, যার অনেকটাই হুজুগ বা নৈরাজ্যের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কোনও শিল্পী তাঁর নিজের মতো করে একটি ছবি এঁকে তাকে রবীন্দ্রনাথের কোনও একটি কবিতা বা গানের সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছেন, এই দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
আলোচ্য প্রদর্শনীটি সে রকম নয়। এতে অনেক গভীর চিন্তা ও বিশ্লেষণের দৃষ্টান্ত আছে। একবিংশ শতকে আমাদের দৃশ্যকলার জগৎ রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারের গণ্ডিতে আর সীমাবদ্ধ নেই। তবু এই বিস্তৃত পরিসরেও রবীন্দ্রনাথ কী করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন, তার সন্ধানই এই প্রদর্শনীর মূল উপজীব্য ছিল। সেটা করতে গিয়ে কোনও কোনও শিল্পী তাঁর নিজস্ব পরিচিত আঙ্গিকে কাজ করে, সেটাকে এমন ভাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছেন, যাকে অনেকটা যুক্তির অযৌক্তিক প্রসারণ বলে মনে হয়।
যেমন অদীপ দত্ত-র স্টিল উলে তৈরি বৃহদাকার জিলিপির ভাস্কর্যটি। এটি তাঁর নিজস্ব পদ্ধতির দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত তথাকথিত অনান্দনিক বস্তুকে নান্দনিকতায় উত্তরণের একটি উত্তর-আধুনিক প্রকল্প। একে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছেন এ ভাবে যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে বা কবিতায় অনেক লোকব্যবহৃত অপরিশীলিত শব্দকে সাহিত্যের শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলেন। এ থেকে একটি জিনিসই প্রতিভাত হয় যে রবীন্দ্রনাথকে প্রয়োজন মতো বহু দূর পর্যন্ত প্রসারিত করে নেওয়া যায়। জয়শ্রী চক্রবর্তী-র ‘কুকুন’ শীর্ষক ইনস্টলেশনটি খুবই বিদগ্ধ উত্তর-আধুনিক ভাবনার রচনা, যাতে পরিবেশ সম্পর্কে শিল্পীর মরমি ভাবনা রূপায়িত হয়েছে। |
|
শিল্পী: অদীপ দত্ত |
চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য তাঁর নিজের মতো করেই ছবি এঁকেছেন। কিন্তু তাকে এমন ভাবে রবীন্দ্রচিত্রে ছায়া ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছেন যে তা একটু অতি-প্রসারণ বলে মনে হয়। কেননা বহু অভিব্যক্তিবাদী ছবিতেই তো আলো-ছায়ার এ রকম দ্বৈত ব্যবহৃত হয়েছে। এরকমই অযৌক্তিক প্রসারণের দৃষ্টান্ত শেখ সাজাহান, পলা সেনগুপ্ত, রিমা কুণ্ডু বা সমীর রায়ের কাজ। অন্যথায় প্রত্যেকের কাজই যথেষ্ট মনন সমৃদ্ধ ও স্বকীয়তায় ভাস্বর। বিশেষত সমীর রায়ের ‘ইউনিভার্সাল লাইফসোর্স’ দ্বিমাত্রিক চিত্রপটে ত্রিমাত্রিক অনান্দনিক বস্তু সংযোগে অসামান্য ঋদ্ধ রচনা।
অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথের জীবনের ঘটনা নিয়ে নিজস্ব আঙ্গিকে কাজ করেছেন কেউ কেউ। আদিত্য বসাক কবির জাপান ও পারস্য ভ্রমণকে ভিত্তি করে রাবীন্দ্রিক আদলে ছবি করেছেন। ছত্রপতি দত্ত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডকে ভিত্তি করে আলোকচিত্র ও সেরিগ্রাফের মাধ্যমে কাজ করেছেন। মঞ্জরী চক্রবর্তী কাজ করেছেন আজকের শান্তিনিকেতনের পরিমণ্ডল নিয়ে। বহু মেয়ে আজ শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কোথাও কি অবনমন ঘটেছে রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারের? এই প্রশ্নকে ঘিরে তাঁর রচনা। দেবরাজ গোস্বামীর চিত্রধর্মী রচনা গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ছবিকে ভিত্তি করে। ‘ক্রাইসিস ইন সিভিলাইজেশন’ ছবিতে তিনি এডওয়ার্ড মুঙ্খ-এর ছবির পরিমণ্ডলে রবীন্দ্রপ্রতিকৃতি স্থাপন করেছেন। ‘প্রফেট’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের একটি আত্মপ্রতিকৃতিকে পুননির্মাণ করেছেন। দেবাঞ্জন রায়ের ‘নটরাজ’ শীর্ষক ভাস্কর্যটি রবীন্দ্রনাথকে নটরাজ হিসেবে উপস্থাপিত করার কৌতুকদীপ্ত প্রয়াস। রবীন্দ্রনাথকে ঈশ্বরে পর্যবসিত করে আমরা যে তাঁকে জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি এর বিরুদ্ধেই তাঁর প্রতিবাদ। তাঁর দ্বিতীয় রচনা ‘ব্লু ফ্লাওয়ার অন রেড লাইন’ ক্যালেন্ডারে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রয়োগ সম্পর্কিত।
শ্রাবণী রায় কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথের পণ্যায়ন নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ছোট ছোট মূর্তি সাজিয়ে করেছেন ‘আইডল টু ডল’। শান্তিনিকেতনে পথের ধারের বিপণিতে এই দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারের নৈরাজ্যের পাশাপাশি কিছু গভীর ভাবনায়ও সমৃদ্ধ এই প্রদর্শনী। |
|
|
|
|
|