শিল্পমহলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বৈঠকেই উঠেছিল বাসন্তী সড়কের দুরবস্থার কথা। সড়কটির সমস্যার কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে এ ব্যাপারে তাঁর হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন স্থানীয় এক শিল্পপতি। বছর কেটে গিয়েছে। শহরের সঙ্গে বানতলার বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের যোগাযোগকারী সেই ১৩ কিলোমিটার রাস্তার বেহাল অবস্থার কিন্তু বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি।
শুক্রবার তারই খেসারত দিতে হল দু’টি বাসের ৪৭ জন যাত্রীকে। বেলা ১১টা নাগাদ কর্মীদের নিয়ে বানতলায় যাচ্ছিল একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার বাস। আচমকা সামনে চলে আসে একটি মোটরভ্যান। ভ্যানটিকে বাঁচাতে গিয়ে উল্টো দিক থেকে আসা সরকারি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার বাসটির। শুক্রবার বানতলা কয়লা ডিপো এলাকার ওই দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছেন দু’টি বাসের মোট ৪৭ জন। এর মধ্যে তিন মহিলা-সহ আট জন আশঙ্কাজনক। |
ওই এলাকায় রাস্তা অত্যন্ত অপরিসর। কোনও বিভাজিকাও নেই। এর মধ্যে বানতলায় বিশেষ আর্থিক এলাকায় শিল্পের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে যানবাহন। মাঝেমাঝেই ছোটবড় দুর্ঘটনাও ঘটছে। এ দিনের দুর্ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তি বাসের চালক বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায় ও হাওড়া-ভোজেরহাট রুটের সিটিসি বাসের চালক ননীগোপাল নায়েক নামে দুই চালকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মন্দিরা দালাল নামে এক মহিলার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। জখমদের অধিকাংশকেই ইএম বাইপাস সংলগ্ন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কয়েক জনকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও ভর্তি করানো হয়েছে। ঘটনার পরে বাসন্তী হাইওয়েতে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ১টা নাগাদ দু’টি বাসকে ক্রেন দিয়ে টেনে প্রগতি ময়দান থানায় নিয়ে আসা হয়। দুপুর দু’টো নাগাদ যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বাসন্তী সড়কের এই অবস্থার কথা শুধু মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনাই নয়, সমস্যার কথা পেশ হয়েছে বিধানসভাতেও। বানতলা বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে ১২০ একর জুড়ে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পতালুক। গত নভেম্বরে বিধানসভার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্যেরা এই অঞ্চল পরিদর্শন করেন। তাঁরা ওই আর্থিক অঞ্চলের রাস্তাঘাট, আলো, জল-সহ বিভিন্ন পরিষেবায় ঘাটতির কথা স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, পরিস্থিতির কথা জানানো হবে মুখ্যমন্ত্রীকেও। পরিদর্শনের ১১ দিনের মাথায় ১৯ ডিসেম্বর বিধানসভায় ওই রিপোর্ট পেশ হয়।
সেই রিপোর্টে মোট পাঁচটি সুপারিশ করে স্থায়ী কমিটি। তার মধ্যে তিনটিই ছিল ওই রাস্তা সংক্রান্ত। কী সেই সুপারিশ?
রিপোর্টে বলা হয়েছিল:
১। রাস্তা চওড়া করতে হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে তৈরি করতে হবে বিভাজিকা।
২। রাজারহাটের সঙ্গে এই রাস্তা জুড়ে দিয়ে বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে হবে।
এর ফলে বানতলা পৌঁছনোর একটি বিকল্প রাস্তাও তৈরি হয়ে যাবে।
৩। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো ও তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কারণ, অধিকাংশ সময় রাস্তার সব আলো জ্বলে না।
সরকারি সূত্রের খবর, ১১০০ একর জমি জুড়ে বানতলা বিশেষ আর্থিক অঞ্চল তৈরি হয়েছে। চর্মশিল্পের পাশেই রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পতালুক। মোট ১৮টি সংস্থা এখানে জমি নিলেও দূষণের কারণে অধিকাংশ সংস্থাই কাজ শুরু করেনি। সেই সমস্যা এখন কিছুটা মিটলেও শহরের সঙ্গে এক মাত্র যোগাযোগের রাস্তার দুরবস্থা বাধা হয়েই থেকে গিয়েছে। আপাতত ওই এলাকায় পুরোদমে কাজ শুরু করেছে এক মাত্র ‘কগনিজেন্ট’ সংস্থাটি। ২০০৭ সালে বানতলা চর্মনগরী সংলগ্ন বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে ২০ একর জমি কিনে রাজ্যে তাদের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় কগনিজেন্ট। ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে তৈরি এই পরিকাঠামোয় ইতিমধ্যেই চার হাজার কর্মী কাজ করছেন। সংস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে এখানে আট হাজার কর্মী কাজ করবেন। ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই কাজ শুরুর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন খোদ শিল্প তথা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এই অঞ্চলের সমস্যার কথা স্বীকার করে তিনি তখন জানিয়েছিলেন, কগনিজেন্টের মতো সংস্থার কাজের সুবিধার জন্য সব রকম সহায়তা করবে সরকার। সেই প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল রাস্তার উন্নয়নও। পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৩ কিলোমিটারের এই রাস্তায় ২৩টি রুটের বাস চলে। এ ছাড়াও চলে কগনিজেন্টের প্রায় ৮০টি বাস। ফলে অপরিসর এই রাস্তা ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেও প্রয়োজনীয় উন্নয়নের কাজ থমকেই থেকে গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, রাস্তা চওড়া করার জন্য জমি পাওয়ার সমস্যাও রয়েছে।
পূর্বতন বাম সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল, ই এম বাইপাস থেকে বানতলা পৌঁছতে ছ’লেনের রাস্তা তৈরি করা হবে। ছয় না হলেও, অন্তত চার লেনের রাস্তা তৈরির আশ্বাস দিয়েছিল বর্তমান সরকারও। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। |