শুক্রবার সকাল পৌনে ১১টা। কলকাতা হাইকোর্টের ১৩ নম্বর এজলাসে তখন পিন পড়লেও শব্দ বোধ হয় শোনা যেত। সিঙ্গুর মামলায় কী রায় হয়, তার জন্য অধীর আগ্রহে রয়েছেন বাদী ও বিবাদী পক্ষ। এজলাসে আইনজীবীদের ভিড়। রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের নিরিখে তারা দ্বিধাবিভক্ত। সবাই অপেক্ষা করছেন, কখন তিনি আসবেন।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে এজলাসে ঢুকলেন তিনি। সঙ্গে সহযোগী বিচারপতি মৃণালকান্তি চৌধুরী। আর নিজের আসনে বসে সময় নিলেন ঠিক সাড়ে তিন মিনিট। রাজ্য সরকারের তৈরি করা সিঙ্গুর আইনকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করে এজলাস থেকে উঠে গেলেন বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ। কলকাতা হাইকোর্টে আজ, শনিবার থেকে তিনি আর বিচারপতি হিসেবে আসবেন না। সোমবার তাঁর হায়দরাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার কথা। কলকাতা হাইকোর্টে কার্যকালের শেষ দিনে সিঙ্গুর মামলার রায় দিয়ে ইতিহাসে জায়গা করে দিলেন বিচারপতি ঘোষ।
অন্য আর পাঁচটা দিনের মতো ‘শেষ দিনেও’ তাঁর প্রাত্যহিক নির্ঘণ্টের কোনও রদবদল হয়নি। সকাল ১০টার কিছু পরে হাইকোর্টে ঢোকেন বিচারপতি ঘোষ। নিজের চেম্বারে টেবিলের উপরে রাখা দেবদেবীর ছবিতে ফুল দিয়ে পুজো করেন। ১১টা বাজার ১০ মিনিট আগে তিনি ঢুকে পড়লেন এজলাসে। ঘোষণা করলেন রায়। তার পরে গেলেন নিজের চেম্বারে। পরে কলকাতা হাইকোর্ট তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা জানাল। জরুরি কাগজে সইসাবুদ করে তাঁর সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে সামিল হলেন তিনি। রাতে বিদায় জানালেন কলকাতা হাইকোর্টকে। |
আগামিকাল, রবিবার তাঁর কলকাতা ছাড়ার কথা। শেষ দিনে এমন একটা ঐতিহাসিক মামলায় রায় কলকাতা হাইকোর্টের আর কোনও বিচারপতি দিতে পেরেছেন কি না, তা মনে করতে পারছেন না প্রবীণ আইনজীবীরা।
বিচারপতি ঘোষের এজলাসে ১৯৯৭ সালের ১৭ মে থেকে যে সব আইনজীবী সওয়াল করছেন, তাঁদের অনেকেই বলছেন, ধারে-ভারে সিঙ্গুর মামলা ব্যতিক্রম হলেও, গত ১৫ বছরে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার নিষ্পত্তি করেছেন তিনি। সেই তালিকায় রয়েছে নন্দীগ্রামে গুলিচালনা সংক্রান্ত মামলাও। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিকাশ শ্রীধর শিরপুরকরের সঙ্গে মিলে বিচারপতি ঘোষ ওই গুলিচালনার ঘটনাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিলেন।
আইনজীবীরা বলছিলেন, বিচারপতি ঘোষ আইনিমহলে পরিচিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ‘স্বার্থ’ দেখার জন্যও। এক আইনজীবীর কথায়, মাকে অপমান ও গায়ে হাত তোলার জন্য পুত্র ও পুত্রবধূকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি ঘোষ। ওই পুত্র ও পুত্রবধূ দু’পক্ষের আইনজীবীর সামনে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, এই নির্দেশের পরে বিচারপতি ঘোষের এজলাসে পুত্র-কন্যাদের হাতে নিগৃহীত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সুবিচার চেয়ে আবেদন করতে শুরু করেন। সেই সব মামলায় বিচারপতি ঘোষ জানিয়ে দেন, যে কোনও অবস্থায় ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে দেখতে বাধ্য থাকবেন। পিতা-মাতা অত্যাচারিত হলে পুত্রকন্যার বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে মামলায় বিচারপতি ঘোষের প্রতিটি নির্দেশও গিয়েছে মা-বাবার পক্ষে। পরে সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় বহাল রাখে। দেশের বহু আদালতেই বাবা-মাকে খোরপোষ দেওয়ার মামলায় এখন বিচারপতি ঘোষের রায়কে উদ্ধৃত করে নির্দেশ দিচ্ছেন বিচারপতিরা। কলকাতা থেকে ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি বাতিল করতে হবে, এই নির্দেশের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে গিয়েছে বিচারপতি পিনাকী ঘোষের নাম। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শিরপুরকরের সঙ্গে ওই ডিভিশন বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি ঘোষ।
এ দিন দুপুরে হাইকোর্টের নতুন ভবনের প্রেক্ষাগৃহে বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষের বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল। পিনাকীবাবু সেখানে জানান, দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে তিনি কলকাতা হাইকের্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিচারপতি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি-সহ অন্য বিচারপতি এবং প্রবীণ ও নবীন আইনজীবীদের যে সাহায্য তিনি পেয়েছেন, তা তিনি আজীবন মনে রাখবেন। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, “আমার বাবা (শম্ভুনাথচন্দ্র ঘোষ) কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। অবসর নেওয়ার পরে তিনি আর কোনও দিন এই আদালতে ফিরে আসেননি। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করব আমিও।” অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন কল্যাণজ্যোতি সেনগুপ্তও। |