নেপালের প্রধান শাসক দল মাওবাদী পার্টিতে ভাঙন ধরিয়াছে। দলের ভাইস-চেয়ারম্যান মোহন বৈদ্য তাঁহার পারিষদ ও অনুগামীদের লইয়া পুষ্পকমল দাহাল (প্রচণ্ড) ও বাবুরাম ভট্টরাই পরিচালিত দল ছাড়িয়া স্বতন্ত্র দল গঠন করিয়াছেন। তাঁহার অভিযোগ, প্রচণ্ড ও তাঁহার অনুচরেরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ বর্জন করিয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের সুবিধাবাদী রাজনীতি অনুশীলন করিতেছেন। ক্ষমতাসীন দলীয় নেতৃত্বকে তিনি আপসকামী ও বিলোপপন্থী বলিয়া গণ্য করেন এবং নেপালি জনসাধারণের সহিত বিশ্বাসঘাতকতার দায়েও অভিযুক্ত করেন। ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশালপন্থীরা তখনকার সি পি আই এমের যে মূল্যায়ন করিয়াছিলেন, প্রচণ্ডদের সম্পর্কে মোহন বৈদ্যদের মূল্যায়ন কতকটা সেই রূপ।
নেপালে রাজনৈতিক শক্তিগুলির চলতি মেরুকরণ যেরূপ, তাহাতে নেপালি কংগ্রেস, কমিউনিস্টরা, মাওবাদী ও মধেসি দলগুলির কেহই একক শক্তিতে পরিষদীয় গরিষ্ঠতা অর্জনে সমর্থ নন। সংবিধান রচনার মতো গুরুতর প্রশ্নেও এই দলগুলির মধ্যে কোনও সর্বসম্মতি সম্ভব হয় নাই, যে জন্য বারংবার গণ-পরিষদের মেয়াদ সম্প্রসারিত করিয়াও একটি প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের কাজ অনারব্ধ থাকিয়া গিয়াছে। যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিদ্বেষ ও অসহযোগ এই পরিষদীয় ও সাংবিধানিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করিয়াছে, মাওবাদীদের মধ্যে উল্লম্ব সাংগঠনিক বিভাজন তাহাকে আরও জটিলই করিবে। মোহন বৈদ্যর সংগঠন প্রচণ্ডের নেতৃত্বে পরিচালিত এবং অধুনা পরিত্যক্ত জনযুদ্ধের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরার অঙ্গীকার করিয়াছে। আত্মসমর্পণকারী গেরিলাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই তাঁহার সমর্থকও। সশস্ত্র যোদ্ধা হিসাবে এই তরুণরা একদা যে সামাজিক প্রতিপত্তি ও মর্যাদা উপভোগ করিত, এখন তাহা নাই। অথচ আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক গেরিলারা সবটা সমর্পণ করে নাই। মোহন বৈদ্যের অনুগামী মাওবাদী জঙ্গিরা যদি প্রচণ্ড-বাবুরামদের চাপে রাখিতে ওই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করে কিংবা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ফিরিয়া যায়, তবে কেবল নেপালের প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত হইয়া পড়িবে না, ভারতেও তাহার প্রতিকূল প্রভাব আসিয়া পড়িতে বাধ্য।
মোহন বৈদ্য তাঁহার ভারত-বিরোধিতার জন্য সুপরিচিত। তিনি নয়াদিল্লিকে নেপালের প্রেক্ষাপটে ‘সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যকামী’ একটি রাষ্ট্র বলিয়াই নিন্দা করেন, কখনওই ‘বন্ধু’ ভাবেন না। তিনি আপন মতাদর্শগত বিশুদ্ধতা ও সাংগঠনিক অস্তিত্ব জাহির করিতে সক্রিয় হইলে অন্য একটি সমস্যাও গুরুতর আকার লইতে পারেতাঁহার গোষ্ঠীর সঙ্গেই ভারতের মাওবাদীদের সম্পর্ক নিবিড়। তাই বৈদ্য গোষ্ঠীর মাওবাদীদের আত্মপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ় ও ওড়িশাতেও মাওবাদী তৎপরতায় গতি সঞ্চার করিতে পারে। নয়াদিল্লি তাই সতর্ক। নেপালের সীমন্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলির নিরাপত্তারক্ষীদের সজাগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। নেপালি মাওবাদীদের সহিত নেপাল সরকারের সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষ হইতে ভারতের সিকিম, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী নেপালিদের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনাও বাড়িতে পারে। অনুপ্রবেশকারীদের সহিত ভিড়িয়া আত্মগোপনকারী জঙ্গিরাও ভারতীয় মাওবাদীদের ঝাঁকে মিশিয়া যাইতে পারে। সতর্ক প্রহরা এবং গোয়েন্দা তৎপরতা তাই বিশেষ জরুরি। |