গ্রিসের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের ফলাফল ইউরোপের অর্থনীতিকে অন্তত সাময়িক ভাবে বিপর্যয়ের মুখ হইতে ফিরাইয়া আনিয়াছে। কিন্তু, এই নির্বাচনের ফলাফলকে শুধু এই পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখিলে তাহার ঐতিহাসিক গুরুত্বের প্রতি অবিচার হইবে। সত্য, এই নির্বাচনের ফল যদি সিরিজা পার্টির দিকে ঝুঁকিত, তাহা হইলে এত ক্ষণে ইউরোপ তথা গোটা দুনিয়ার অর্থনীতিতে এক বিপুল ভূমিকম্প অনুভূত হইত। গ্রিস ইউরো অঞ্চল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলে তাহার প্রকৃত আর্থিক তাৎপর্য যতখানি, ভূমিকম্পের মাত্রা তাহার অধিক হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, গ্রিসের নিষ্ক্রমণের অর্থ শুধু কিছু ঋণ পরিশোধ না হওয়া নহে, তাহা একটি ব্যবস্থা ভাঙিয়া পড়ার সূচক। তাহার প্রতিক্রিয়া তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক। গ্রিসের নির্বাচনে নিউ ডেমোক্র্যাসির জয়লাভ এবং সরকার গঠন আপাতত সেই সম্ভাবনায় দাঁড়ি টানিয়াছে। নিউ ডেমোক্র্যাটরা ঋণ পরিশোধের পক্ষপাতী। তাঁহারা কেবল কিছু বাড়তি সময় চাহিয়াছেন। জার্মানি, ফ্রান্সের ন্যায় দেশগুলির সহিত ঋণ পুনর্গঠন লইয়া দর-কষাকষি চলিবে, উভয় পক্ষ একটি মধ্যবর্তী অবস্থান স্বীকার করিবে বলিয়া আশা করা চলে। আপাতত আশামাত্র। কারণ ইউরোপের অর্থনীতি এবং রাজনীতি এমন একটি পথসন্ধিতে দাঁড়াইয়া আছে যে কোনও কিছুই এখন নিশ্চিত নহে। তবে, গ্রিসের নির্বাচনী ফলাফল বলিতেছে, সমাধানসূত্র পাওয়া অসম্ভব নহে।
সিরিজা পার্টি যদি গ্রিসে ক্ষমতা দখল করিত, তবে সম্পূর্ণ উপাখ্যানটি ভিন্ন রূপ লইত। গ্রিসের রাজনীতিতে এই বামপন্থী দলটি কার্যত এক ভুঁইফোঁড় শক্তি দেশের আর্থিক সংকট, এবং ঋণ পরিশোধ করিবার জন্য আই এম এফ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের চাপ এই দলটির উত্থানের রূপকার। কিন্তু, গ্রিসের মানুষ এই নির্বাচনে সিরিজা পার্টিকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। অর্থাৎ, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ঋণ পরিশোধ না করিবার নীতিতে সায় দেন নাই। ইহাই গণতন্ত্রের শক্তি যে সমাধান কার্যত অসম্ভব বোধ হইতেছিল, গণতন্ত্র তাহাকেই প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। আবার, এই গণতন্ত্রই গ্রিসের সংকটকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়াছে। গ্রিসে যদি অগণতান্ত্রিক শাসন থাকিত, তবে আর্থিক সংকটের এক রকম সমাধান হয়তো সম্ভব হইত কঠোরতম আর্থিক নীতি চাপাইয়া মানুষকে তাহা মানিতে বাধ্য করা হইত। না মানিলে তাহার পরিণতি কী হইতে পারে, অগণতান্ত্রিক দুনিয়ায় সেই উদাহরণের অভাব নাই। কাজেই, লোকে বাধ্য হইয়াই সেই নীতি মানিত। তাহাতে সংকট হয়তো কাটিত, কিন্তু ইউরোপ গণতন্ত্রের যে আদর্শকে চির কাল উচ্চাসনে বসাইয়াছে, তাহার শেষ থাকিত না।
গণতন্ত্রই আপাতত ইউরোপের জিয়নকাঠি। লক্ষণীয়, গ্রিসের মানুষ মে মাসের গোড়ায় যে ভাবে ভোট দিয়াছিলেন, তাহার দেড় মাস পরে জুনের ভোটে ধরন পাল্টাইয়াছে। অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ নিউ ডেমোক্র্যাসির নীতিকেই সমাধানসূত্র ভাবিয়াছেন। তাঁহারা ঋণের টাকা মারিয়া দিতে চাহেন না, কিন্তু গলায় গামছা দিয়া টাকা আদায় করিবার আই এম এফ-সুলভ ব্যবস্থাতেও তাঁহাদের আপত্তি আছে। এই আপত্তিকে সম্মান করা প্রয়োজন। তাহার দায়িত্ব অ্যান্টনিস সামারাসের যেমন, অ্যাঞ্জেলা মার্কেল বা ফ্রাসোয়াঁ ওলাঁদেরও কম নহে। সামারাস নির্বাচনের পূর্বে যে অবস্থানে ছিলেন, তাহা হইতে সরিয়া যদি ইউনিয়নের চাপের নিকট আত্মসমর্পণ করেন, গ্রিসে ফের আগুন জ্বলিতে সম্ভবত বিলম্ব হইবে না। তাহাতে ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়াটি ফের বিশ বাঁও জলের তলায় চলিয়া যাইবে। মার্কেলদেরও বুঝিতে হইবে, গ্রিসের মানুষকে কঠোর নীতির জাঁতাকলে পিষিয়া ফেলিলে টাকাও ফেরত পাওয়া যাইবে না, হয়তো গ্রিসও গণতন্ত্রের পথ ছাড়িয়া উগ্র বামপন্থার রাস্তায় হাঁটিতে আরম্ভ করিবে। ধনতন্ত্রের নিজের স্বার্থেই গণতন্ত্রকে লালন করা উচিত। গণতন্ত্র প্রতিদানে বিমুখ নহে। গ্রিসের নির্বাচনের ফল তাহার সাক্ষী। |