রোগী ফিরিয়ে চিকিৎসায় দায় এড়ানো, বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যোগসাজশ আর চিকিৎসকের এমন ‘ব্যবহার’ জেনে শুনেও হাসপাতাল সুপারের নির্বিকার, ‘খোঁজ’ নিয়ে দেখার অনর্থক আশ্বাসকৃষ্ণনগর জেলা সদর হাসপাতালের এ ‘ব্যামো’ আর সারছে না।
সোমবার প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা এক প্রসূতিকে ফিরিয়ে দেওয়াই নয়, পাশের নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শেও পরোক্ষে সায় দিলেন যে চিকিৎসক, দিন কয়েক আগে প্রায় একই কারণে রোগীর বাড়ির লোকের কাছে ‘হেনস্তা’ হয়েছিলেন তিনি। তিনি ওই হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মানিক মণি। কেন এমন করলেন? নিরুত্তাপ গলায় ওই চিকিৎসক বলেন, “ঝুঁকি নিতে চাইনি। তাই অন্যত্র রেফার করে দিয়েছিলাম।” আর সব জেনেও ওই হাসাপাতেলর সুপার কাজল মণ্ডলের গতে বাঁধা বয়ান, “খোঁজ নিয়ে দেখছি।”
|
অভিযুক্ত চিকিৎসক। |
কৃষ্ণনগর হাসপাতালের বিরুদ্ধে দায়সারা চিকিৎসা কিংবা গাফিলতির অভিযোগ ওঠে নিত্য। গত বছর এই হাসপাতালেই এই বাসপাতালেই এক প্রসূতির সিজার করে পাওয়া গিয়েছিল ‘গ্যাস!’ আর, অন্য এক চিকিৎসক সিজার করার সময়ে সদ্যোজাতের মাথায় কাঁচি চালিয়ে দিয়েছিলেন। শিশুটি স্বাভাবিক ভাবেই বাঁচেনি। পাশাপাশি, এক শেরণির চিকিৎসকের প্রসূতিদের আশপাশের নাসিংহোমে ‘রেফার’ করে দেওয়ার ‘রোগ’ও নতুন নয়।
মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের প্রত্যন্ত গ্রাম গোপালপুর থেকে ঝুমা দাসকে জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। সোমবার রাত ন’টা নাগাদ তিনি ওই চিকিৎসকের অধীনে ভর্তি হন। ঝুমাদেবীর বাড়ির লোকের অভিযোগ, পরের দিন, মঙ্গলবার সকালে ওই চিকিৎসক জানান, প্রসবের ঢের দেরি। প্রসূতিকে নিয়ে যেতেও বলেন তিনি। আশ্চর্যের ব্যাপার, ঝুমাদেবীকে নিয়ে বাড়ির লোক যখন ফিরে যাওয়ার তোড়জোর করছেন তখন আচমকা প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয় তাঁর। ছটফট করতে থাকেন সদ্য তরুণী। অচেনা হাসপাতালে ঝুমার সব্জি বিক্রেতা বাবা রবীন্দ্রনাথ দাস এ দিক ও দিক দৌড়ে চিকিৎসক মানিক মণিকে না পেয়ে অন্য চিকিৎসকদের হাতে পায়ে ধরেন, “মেয়েটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে একটু দেখে দেবেন!” রবিবাবু জানান, সকলেই মাথা নেড়ে জানিয়ে দেন, “আমার পেশেন্ট নয়, দেখতে পারব না।”
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ছটফট করেই চলেন ঝুমা। রবিববাবু বলেন, “রাত আট-টা নাগাদ মানিকবাবু হাসপাতালে এসে ঝুমাকে দেখে দ্রুত কল্যাণীর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। আমি বলি, খুবই গরীব আমরা, গাড়ি ভাড়া করে কল্যাণী নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। রেফার না করে ওই হাসপাতালেই প্রসব করানোর জন্য তাঁর হাতে পায়ে ধরি। উনি শুনলেনই না।”
এই সময়ে অসহায় বাবার পাশে এগিয়ে আসে এক দালাল। রবিবাবু বলেন, “ছেলেটি মানিকবাবুর সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলে। তারপরে বলে, ‘চলুন নার্সিংহোমে নিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন।’ সে আমাদের কাছেই একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। সেখানে খরচ শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়, ১৭ হাজার টাকা। আমি বলি মেরে কেটে ৮ হাজার দিতে পারি।” যা শুনে প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে ওই প্রসূতি ও তাঁর বাবা-কে নার্সিংহোম থেকে বের করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
রাস্তায় পড়েই ছটফট করতে থাকে তরুণী। আশপাশের দোকানের লোকজন তা দেখে ছুটে আসেন। তাঁদেরই এক জন অঙ্কুর দে বলেন, “মেয়েটি প্রসব যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছিল। আমরাই ওঁকে ফের হাসপাতালে নিয়ে যাই। প্রায় জোর করে ডেকে আনি অন্য স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ চঞ্চল সরকারকে।” তাঁর পরামর্শেই এ বার ‘অভিযুক্ত’ মানিকবাবু অস্ত্রোপচার করেন ঝুমার। তিনি এবং তাঁর পুত্র সন্তান এখন ভাল আছেন। তা হলে ঘন্টা কয়েক আগে ওই প্রসূতিকে দু-দুবার ফিরিয়ে দিলেন কেন?
মানিকবাবু বলেন, “মহিলা যখন প্রথম ভর্তি হন, তখন তাঁর প্রসব যন্ত্রণাই ওঠেনি। তবে সেটা কিসের যন্ত্রণা বুঝতে না পারায় কল্যাণীতে রেফার করেছিলাম।”
ইউএসজি করলেন না কেন?
মানিকবাবু আমতা আমতা করেন।
তা হলে এক ঘন্টার মধ্যে ফের যে ব্যাথা উঠল?
“দ্বিতীয় বার যে ব্যাথা উঠেছিল তা অবশ্য প্রসব যন্ত্রণা। অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই তাই সিজার করতে হল।”
তবে ওই হাসপাতালের অন্য স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ চঞ্চলবাবু বলেন, “দেখেই মনে হয়েছিল ওঁর সিজার করা দরকার। আর একটু দেরি হলে গর্ভস্থ সন্তান কেন মা-ও মারা যেতে পারত। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই ইউএসজি করে নেওয়া উচিত ছিল।”
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস ঘটনাটি জেনেছেন। তিনি জানান, এ ব্যাপারে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু নিয়ম মাফিক সেই রিপোর্ট পেয়েও কী কোনও ফল হবে? অসিতবাবু উত্তর দিতে পারেননি। স্পষ্ট উত্তর মেলেনি হাসপাতালের সুপার কাজলবাবুর কাছেও। তিনি জানান, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ওই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতিরও সভাপতি জেলার মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস। এ দিন তিনি বিধানসভায় ছিলেন। সকালে খবরটি জানানো হয়েছিল তাঁকেও। বলেন, “খোঁজ নিচ্ছি।” বিকেলে জানান, তখনও খোঁজ নিতে পারেননি।
প্রশ্ন, খোঁজ নিয়ে কিংবা খতিয়ে দেখে হাসপাতালে ‘রোগ’ ধরা পড়বে তো? |