উদ্দেশ্য ছিল, নিজেদের অতীত সাফল্যের এক তরফা গুণগান না-গেয়ে সমালোচনার মঞ্চও তৈরি রাখা। সেই মঞ্চই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রশ্নে চাপ বাড়িয়ে দিল আলিমুদ্দিনের উপরে!
বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার ৩৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আলোচনাসভায় এ রাজ্য থেকে সিপিএমের দুই পলিটব্যুরো সদস্য বিমান বসু ও সূর্যকান্ত মিশ্রকে মঞ্চে বসিয়েই রাষ্ট্রপতি-পদে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন না-করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেন রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র! প্রণববাবুর নাম অবশ্য তিনি করেননি। তবে অর্থনৈতিক যুক্তিতেই যে বামেদের প্রণববাবুকে সমর্থন করা উচিত নয়, তা বোঝাতে কাপর্ণ্য করেননি। আলিমুদ্দিনের তরফে প্রণববাবুর পক্ষে দাঁড়ানোর মূল প্রবক্তা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অবশ্য বুধবার সন্ধ্যায় অশোকবাবুর ওই বক্তব্যের সময় নজরুল মঞ্চে ছিলেন না। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, অনুষ্ঠানের শুরুতে বামফ্রন্টের তরফে ‘পশ্চিমবঙ্গ কোন পথে’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের পরেই বুদ্ধবাবু মঞ্চ ছেড়ে চলে যান। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিপিএমের পলিটব্যুরোর আর এক সদস্য নিরুপম সেন কলকাতার বাইরে থাকায় এই আলোচনাসভায় ছিলেন না। |
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দলের অবস্থান ঠিক করতে আজ, বৃহস্পতিবার সকালেই দিল্লি যাচ্ছেন বিমানবাবু, সূর্যবাবুরা। বুদ্ধবাবুর অবশ্য যথারীতি যাওয়ার কথা নয়। দিল্লিতে সিপিএম পলিটব্যুরোর বৈঠকের পরে চার বাম দলের নেতৃত্ব আলোচনায় বসবেন। ঠিক তার আগের সন্ধ্যায় বাম জমানার প্রথম অর্থমন্ত্রী অশোকবাবু দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার থমকে যাওয়া, মুদ্রস্ফীতির ভয়াবহ চিত্র, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, “অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তার পরে এই কয়েক দিন আগে বললেন, যদি বর্ষা ঠিকমতো হয়, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলের দাম কমে, তা হলে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে! এই পরমবিজ্ঞ বিত্তমন্ত্রীকেই এখন রাষ্ট্রপতি করা হবে! কিছু আর বলার নেই!” ইউপিএ সরকার আর্থিক উদারনীতির পথে হেঁটে আম আদমির জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে বলে অভিযোগ করে ওই আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বামেরা। তাই ‘নীতিগত প্রশ্নে’ই ইউপিএ-র প্রার্থীকে সমর্থন করা উচিত নয় বলে মত দিয়েছে বাম শরিক সিপিআই। অশোকবাবুর গলায় সেই যুক্তিরই প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে। তিনি বলেছেন, “যারা আমাদের শোষণ করেই চলেছে, যাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করছি, তারাই বলছে আমাদের রাষ্ট্রপতিকে জিতিয়ে দাও! তোমার গ্রামের মানুষকে ভোট দাও!”
বস্তুত, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির অনেক ‘বিচিত্র’ খণ্ডচিত্র যে সামনে আসছে, তা-ই তুলে ধরতে চেয়েছেন অশোকবাবু। সেই সূত্রেই নাম না করে এক হাত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর কথায়, “রাষ্ট্রপতি নির্বাচন উপলক্ষে এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রী নৈতিকতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হচ্ছেন! যিনি সত্য-মিথ্যার ফারাক জানেন না! সকালে যা করেন, বিকালে তার উল্টো ভাবেন। দুপুরে যা ভাবেন, পর দিন সকালে অন্য কথা বলেন। এক বছরে গণতন্ত্রের নামে যিনি দলতন্ত্র, এমনকী, ব্যক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর মুখে নৈতিকতার কথা!”
প্রসঙ্গত, বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার বর্ষপূর্তি উপলক্ষেই এ দিন মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারের এক বছরের কাজের মূল্যায়ন করে পাল্টা পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন বিমানবাবুরা। যেখানে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার প্রথম বছরে কোন কোন কাজে হাত দিয়েছিল, তার খতিয়ানও স্মরণ করানো হয়েছে। বিমানবাবুর বক্তব্য, “পাঁচ বছরের কাজ এক বছরে শেষ করে ফেলেছেন যাঁরা বলছেন, তাঁদের কাজের চেহারা তুলে ধরতে চেয়েছি। বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে কী কাজ করেছিল, তা-ও এই বইয়ে আলোচনা করেছি।” তাঁদের সরকারের স্ব-মূল্যায়ন করে মমতা যে পুস্তিকা (‘প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’) তৈরি করছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ কোন পথে’ তারই পাল্টা। নজরুল মঞ্চের আলোচনাসভায় বক্তা ছিলেন অর্থনীতিবিদ সি পি চন্দ্রশেখর, সাংবাদিক এন রাম। আর এক সাংবাদিক এম জে আকবর আসতে পারেননি। তবে বক্তাদের মধ্যে বামফ্রন্টের কাজের সমালোচক ছিলেন একমাত্র অশোকবাবুই। যিনি আলোচনা ছাড়াই জমি অধিগ্রহণ বা শিক্ষা-প্রশাসন-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ‘দক্ষ’ লোকের বদলে ‘বিশ্বস্ত’দের অগ্রাধিকার দেওয়ার ‘ভুল’ বিমানবাবুদের সামনেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। যা শোনার জন্য বুদ্ধবাবু শেষ পর্যন্ত ছিলেন না! |